ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১৮ এপ্রিল : রাজধানীর নামিদামি শপিং মল থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার দোকান এবং গ্রাম ও মফস্বলে অবাধে বিক্রি হচ্ছে ক্ষতিকর নকল ও নিম্নমানের প্রসাধনী। নাম না জানা অখ্যাত এসব প্রসাধনী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের না আছে কোন অনুমোদন কিংবা মান নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সার্টিফিকেট এবং না আছে বিএসটিআই কর্তৃক বাজারজাতকরণের ছাড়পত্র। এসব প্রসাধনী কিনে রীতিমতো প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। অথচ নেই কোনো প্রতিরোধ-প্রতিকার। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ নকল প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবসা। সস্তায় এসব নকল প্রসাধনী কিনে সাধারণ মানুষ যেমন হচ্ছে প্রতারিত তেমনই আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এবং এগুলো ব্যবহার করে বাড়ছে শরীরে চর্মরোগের নানাবিধ ঝুঁকি।
নকল ও নিম্নমানের সেভিং ফোম, সেভিং লোশন বা ক্রিম, পারফিউম, টেলকম পাওডার, সুগন্ধি কেশ তেল, বিউটি ক্রিম, স্যাম্পু, কন্ডিশনারসহ বিভিন্ন প্রসাধনী তৈরি করে বাজারজাত ও অবাধে বিক্রি করছে নাম সর্বস্ব কতিপয় কসমেটিক উৎপাদনকারী যাদের না আছে কেমিক্যাল প্রস্তুতের লাইসেন্স, মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদন, এমনকি নাই বিএসটিআইয়ের কোনো অনুমতিও। বিভিন্ন হাট-বাজার বা বিপণিবিতানের আশপাশে ফুটপাথেও অবাধে বিক্রি হচ্ছে এসব নকল ও ভেজাল প্রসাধন সামগ্রী।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্বমানের ব্র্যান্ড গার্নিয়ার, লরেল, রেভলন, হেড এ্যান্ড শোল্ডার, লাক্স লোশন, মাস্ক লোশন, এ্যাকুয়া মেরিন লোশন, পেনটিন, নিভিয়া লোশন, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান, সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, পয়জন, রয়েল, হ্যাভক ও কোবরা। অলিভ অয়েল, কিওকারপিন, আমলা, আফটার সেভ লোশন, জনসন, ভ্যাসেলিন হেয়ার টনিক, জিলেট ফোম, প্যানটিক প্রোভি ও হারবাল এ্যাসেনশিয়াল লোশনের নামে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রী হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। দেশে ভেজাল প্রসাধনী ব্যবসায় সম্পৃক্তরা আইনের ফাঁক গলে সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, নগরীর গুলিস্তান, চকবাজার, যাত্রাবাড়ী, নিউমার্কেট, মহাখালী, গুলশান, মিরপুরসহ বিভিন্ন বিপণিবিতান ও ফুটপাতে পাইকারী ভাবে বিক্রি হচ্ছে এ সকল নকল প্রসাধনসামগ্রী।
সূত্র মতে, শুধু রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় ৩ শতাধিক নকল প্রসাধনসামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীতে এক ডজনেরও বেশি ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কারখানা রয়েছে। নগরীর বাইরেও রয়েছে আর অসংখ্য ভেজাল কারখানা। এসব কারখানা থেকে বিভিন্ন হাত ঘুরে নকল প্রসাধনী দেশের বড় বড় সুপার শপ, বিপণিবিতান ও মফস্বল এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।
চকের কয়েকজন প্রসাধনী ব্যবসায়ী জানান, ঢাকার গুলশান, বনানী, মহাখালী, মগবাজার ও মৌলভীবাজার এলাকায় ভেজাল প্রসাধনসামগ্রীর আমদানিকারকদের অফিস রয়েছে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় নকল প্রসাধন পণ্য তৈরি ও বিক্রির কারখানা হচ্ছে চকবাজারে। আর চকবাজারের চক মোগলটুলির খান মার্কেটে গড়ে উঠেছে নকল প্রসাধনী তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানা। ৭৫ ভাগ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের কোন নাম ঠিকানা নেই। পুরান ঢাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে নকল-ভেজাল ফেসিয়াল ক্রিম, লোশন ও শেভিং ফোমের কারখানা।
কতিপয় চালাক ও অসাধু ব্যবসায়ী নকলের দায়ে মামলা এড়ানোর জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিকের সঙ্গে রং মিশিয়ে বানানো নিম্নমানের এধরনের প্রসাধনী পণ্য বাজারজাতকরণে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে। নামকরা কোম্পানির জিনিসগুলো হুবহু নকল করে তাতে মেইড ইন জার্মানির জায়গায় মেইড অ্যাস জার্মানি স্টিকার লাগিয়ে আবার কখনও ইউনিলিভার কোম্পানির ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির আদলে ফেজার অ্যান্ড লাভলি, ফুয়ার অ্যান্ড লাভলি ইত্যাদি নামে রং ফরসাকারী ক্রিম, বিশ্বখ্যাত ‘রন্স বারবার শপে’র নামে ঢাকার কামরাংঙ্গিরনচর এলাকায় রন’স কসমেটিক্স নামের কারখানায় উৎপাদিত রন’স শেভিং ফোম, রন’স ফেইস ওয়াশ, রন’স আফটার সেইভ লোশান্, রন্স এপ্রিকট, রন্স স্পিডি ন্যাচারাল ব্লাক ইত্যাদি প্রসাধনী তৈরি করছে ও একচেটিয়া বিক্রি করছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এলাকার পার্লার ও ‘সেলুন ও হেয়ার ড্রেসিং’ এর দোকানগুলোতে ফলে চর্মরোগ থেকে শুরু করে মারাত্মক স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন ব্যবহারকারীরা।
রন’স কসমেটিক্সের উৎপাদিত এই সকল নিম্নমানের প্রসাধনী্তে তরুন ও যুবকদের আকৃষ্ট করতে ফেইসবুক, ইউটিউবে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন ব্যবহার আসছে।
এ সকল পণ্যের মোড়কে বিএসআইআর, বিএসটিআই এমনকি আইএসও ৯০০০ : ২০০৮ সার্টিফাইড লিখতেও দ্বিধা করে না এই সকল অসাধু ব্যবসায়ীরা।
নিম্নমানের নকল ও ভেজাল প্রসাধন সামগ্রীর প্রভাব সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারে ত্বকের সাধারণ লাবণ্যই শুধু নষ্ট হয়ে যায় না। এর ব্যবহারে প্রাথমিকভাবে ব্যবহারকারীর কন্টাক্ট ডারমাটাইসিস হয়, চামড়া লাল হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন তৈরি করতে পারে। এমন কি স্কিন ক্যান্সার হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। নকল ও নিম্নমানের এ সকল প্রসাধন সামগ্রীতে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে তা মাত্রাতিরিক্ত এবং কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই, ফলে এলার্জি, ক্ষত, চামড়া কালো হয়ে যাওয়া, একজিমা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছেই।
এসব পণ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বনামধন্য বিউটিশিয়ান মিসেস ফরিদা তৌফিক বলেন, ত্বকাক্রান্ত যেসব মানুষ আমাদের কাছে আসে তাদের প্রায়েরই মুখে কালো দাগ, রাশ, গোটা, এলার্জি, অত্যাধিক ঘাম ঝরা অন্যতম। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে যখন জানতে চাইলে তারা কিছু ক্রিম, লোশনের কথা বলে। যেগুলোকে আমরা পরীক্ষা করে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছি যার ইমিডিয়েট এলার্জিক রিঅ্যাকশনে মানুষ মারা পর্যন্ত যেতে পারেন।