ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১৩ এপ্রিল : বাংলাদেশে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যাচেষ্টার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসাইন রিপনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বুধবার রাত ১০টা ১ মিনিটে তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হয়।
মুফতি হান্নান ও বিপুল কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে ছিলেন। সেখানেই তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অপরদিকে রিপনের ফাঁসি কার্যকর হয় সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে।
কাশিমপুর কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান কারাফটকে সাংবাদিকদের জানান, রাত ১০টায় মুফতি আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ওরফে বিপুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।–মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকরের পর ব্রিফ করছেন সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান
এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এরপর পর্যাপ্ত নিরাপত্তায় তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মুফতি হান্নানের লাশ গোপালগঞ্জে এবং শরীফ শাহেদুল বিপুলের লাশ চাঁদপুরে পাঠানো হবে।
অন্যদিকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ছগির মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার রাত ১০টা ১ মিনিটে জঙ্গী দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। মরদেহের ময়নাতদন্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। দেলোয়ার হোসাইন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য ৮৫ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জল্লাদ ফারুকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্যানেল রিপনের ফাঁসি কার্যকর করে বলে কারা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এর আগে, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মুফতি হান্নান ও বিপুলকে তওবা পাঠ করান কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মামুনুর রশীদ। এরপর দুজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন গাজীপুরের সিভিল সার্জন মঞ্জুরুল আলম।
উল্লেখ্য, এক যুগেরও বেশি সময় আগে সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যার মামলায় তাদের মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।
বুধবার রাতে দুই জঙ্গি মুফতি হান্নান ও বিপুলের ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি হিসেবে একের পর এক কারাগারে ঢোকেন ফাঁসি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল কবির ৭টা ৪০ মিনিটে কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করেন। পরে কারা মহাপরির্দক বিগ্রেডিয়ার সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন সন্ধ্যা ৭টা ৫৭ মিনিটে কারাগারে প্রবেশ করেন। এর আগে সাড়ে ৭টায় ঢোকেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ। সন্ধ্যা ৭টা ৩৩ মিনিটে ঢোকেন সিভিল সার্জন সৈয়দ মঞ্জুরুল হক। গাজীপুর কাশিমপুর কারাগারে ঢোকে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সও।
এদিকে কারা কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে বুধবার সকালে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাৎ করেছেন মুফতি হান্নানের পরিবার সদস্যরা। বুধবার ভোর ৬টার দিকে কারাগারে পৌঁছানোর পর মুফতি হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভীন, দুই মেয়ে নিশাত ও নাজনীন এবং বড় ভাই আলী উজ্জামান সকাল ৭টা ১০ মিনিটে তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পান। তখন থেকে তারা প্রায় ৭টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত হান্নানের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তারা বেরিয়ে যান।
এদিকে জঙ্গি রিপনের ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢোকেন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউল ইসলাম। বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় তারা কারাগারে ঢোকেন। এর আগে সন্ধ্যায় সেখানে ঢোকেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ঈমাম মুফতি বেলাল হোসেন। তিনি পৌনে ১০টার দিকে রিপনকে তওবা পড়িয়ে কারাগার থেকে বের হন। এরপর কারাগারে প্রবেশ করেন সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. অমল রতন সাহা।
রিপনের সঙ্গেও শেষ সাক্ষাৎ করেন স্বজনরা। সাক্ষাত করেন তার বাবা আবু ইউসুফ, মা আজিজুন্নেছা, ভাই নাজমুল ইসলাম ও তার স্ত্রী।বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিটে ১টি মাইক্রোবাস ও একটি সিএনজি অটোরিকশায় করে রিপনের ২১ জন স্বজন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। রাত৮টা ৪০ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বের হয়ে যান।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. সগির মিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, জঙ্গি রিপনের মা, বাবাসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয় স্বজন তার সাথে দেখা করেন।
তিন জঙ্গির ফাঁসি উপলক্ষে উভয় কারাগারে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের হযরত শাহজালালের (র.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। এতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত এবং আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এ মামলার রায়ে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিচারিক আদালত পাঁচ আসামির মধ্যে মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদণ্ড, মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং দেলোয়ার হোসেন রিপনকে সিলেট কারাগারে রাখা হয়।
নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করতে প্রয়োজনীয় নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি ২০০৯ সালে আসামিরা জেল আপিলও করেন। পরে গত বছরের ৬ জানুয়ারি এ মামলায় হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। বিচারিক আদালতের দণ্ড বহাল রেখে ১১ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট।
গত বছরের ২৮ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। ১৪ জুলাই আপিল করেন দুই আসামি হান্নান ও বিপুল। অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রিপন আপিল না করলেও আপিল বিভাগ তার জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ করেন। আপিলের শুনানি শেষে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর আসামিদের আপিল খারিজ হয়ে যায়। পরে গত ১৭ জানুয়ারি এ রায় প্রকাশের পর আসামিরা রিভিউ করেন। রিভিউ আবেদন খারিজের পর ২৭ মার্চ মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী বিপুল কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। পরে রাষ্ট্রপতি তাদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। সোমবার রাষ্ট্রপতির কাছে করা প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের কপি এ কারাগারে পৌঁছায়।