ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,আবদুল গাফফার চৌধুরী,২০ জানুয়ারি : সোমবার নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে কয়েকজন পলাতক আসামিও রয়েছেন। এই চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে যেমন প্রাণদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনি র্যাবের অভিযুক্ত কর্মকর্তারাও নিজেদের বাঁচাতে পারেননি। লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ (চাকরিচ্যুত), মেজর আরিফ হোসেন (চাকরিচ্যুত), লে. কমান্ডার মাসুদ রানা (চাকরিচ্যুত) যেমন মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন, তেমনি র্যাবের আরো অভিযুক্ত সদস্যরাও দণ্ড এড়াতে সক্ষম হননি।
এ রায়টিকে এ জন্যই জোর গলায় অভিনন্দন জানাতে হয় যে এ রায়টি বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে অধুনা প্রচলিত একটি অভিমতকে পাল্টে দেবে। এই অভিমতটি হলো, বাংলাদেশে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়া, সাগর-রুনির হত্যা মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকা, ব্লগার হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে বিলম্ব ও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা মানুষের মনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা হতাশা তৈরি করেছিল। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় মানুষের মন থেকে এই হতাশাই শুধু অনেকটা কাটাবে না, বর্তমান সরকারের আমলে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা সম্পর্কেও মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনবে। ‘আইন সবল ও ক্ষমতাশালীদের স্পর্শ করতে পারে না’ বলে বাজারে যে কথাটি প্রচলিত আছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় সেই কথাটিকে অনেকটা অসার প্রমাণ করে দিল। এই মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ধনী ব্যবসায়ী, সাবেক কাউন্সিলর এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। ভারতে পালিয়ে গিয়েও তিনি বাঁচতে পারেননি। পলাতক (সম্ভবত ভারতে) বিএনপি নেতা এবং নানা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত (তার মধ্যে কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডও রয়েছে) হারিছ চৌধুরীকে ধরে এনে বিচারে সোপর্দ করা ও দণ্ড দেওয়া এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনকে বিদেশ থেকে ধরে এনে অল্প দিনের মধ্যে বিচার করে দণ্ড দেওয়া গেছে, এটা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটা বড় প্লাস পয়েন্ট।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা আইন ভঙ্গ বা কোনো অপরাধ করলে ক্ষমতার জোরে আইনের ফাঁক দিয়ে সহজেই বেরিয়ে যান বলে আমাদের দেশে যে কথাটি প্রচলিত, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় সেই অপবাদ থেকেও দেশটাকে অনেকটা মুক্তি দিল। র্যাবের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদেরও প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রমাণিত হলো, র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ মামলার ব্যাপারে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে চায়নি। ভারতে নারী ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত সামরিক বাহিনীর এক অফিসারকে দণ্ড থেকে বাঁচানোর জন্য সামরিক বাহিনীর প্রভাবশালী একদল কর্মকর্তা প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। বাংলাদেশে র্যাবের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠেনি, এটা একটা বড় আশার ও ভরসার কথা।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। এই দিন সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র, দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। একই দিনে প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার তাঁর ড্রাইভারসহ অপহৃত হন। পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিলম্ব করেনি এবং অত্যন্ত তত্পরতার সঙ্গে ক্ষমতাশালী অভিযুক্তদেরও ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। অভিযুক্তদের বিচারেও বিলম্ব ঘটেনি। তনু হত্যা মামলা ও সাগর-রুনি হত্যা মামলায়ও পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগ এ ধরনের তত্পরতা দেখাতে পারলে সরকারের সাফল্যের তালিকায় আরো একটি পালক যোগ হতো।
তবু নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় যে বলতে গেলে দ্রুতই একটা সমাপ্তি ঘটল এবং প্রভাবশালী রুই-কাতলা আসামিরাও দণ্ড থেকে রেহাই পেলেন না—এটা বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বিভাগীয় একটা বড় সাফল্য। ‘ন্যায়বিচার বিলম্বিত হলে তা অস্বীকৃত হয়’ বলে যে কথাটা বাজারে প্রচলিত, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় তা অন্তত ঘটেনি—এ কথা এখন জোর গলায় বলা যায়। পুলিশ, তদন্তকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগ সবাইকে এ জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়।
আমরা দেশে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিস্তার লাভের কথা বলি। বাংলাদেশে এ দুটি অভিশাপের এখনো বিস্তার বন্ধ হয়নি। দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য দুদক গঠিত হয়েছে, নানা কঠোর আইন হয়েছে, কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। সন্ত্রাসের বেলায়ও এ কথা সত্য। আসল কথা, আইন করে কিছু করা যায় না, যদি আইন পালনের ব্যবস্থা না হয়। এ জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের বড় রক্ষাকবচ হলো আইনের শাসন। Rule of Law আইনের শাসন যদি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসও নিজ থেকেই বন্ধ হতে বাধ্য। সে জন্য নতুন নতুন আইন করতে হবে না।
ঢাকায় যানবাহন চলাচলে বড় বেশি অব্যবস্থা। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও ট্রাফিক আইন আছে। পশ্চিমা দেশে সবাই তা মেনে চলে। বাংলাদেশে কেউ মানে না, বিশেষ করে সরকারি ও রাজনৈতিক হোমরাচোমরাদের একটা বড় অংশ। ফলে অসংখ্য উড়াল সড়ক বানিয়েও ঢাকার ভয়াবহ যানজট কমানো যাচ্ছে না। ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশ তো হোমরাচোমরা গোছের কারো গাড়ি ট্রাফিক আইনে ধরে সেই হোমরাচোমরার হাতে চড়-থাপ্পড় খেয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
অপরাধ দমনের বেলায়ও এ কথা সত্য। ওপরতলার মানুষ যদি বড় বড় অপরাধ করে দণ্ড এড়ায় আর নিচুতলার মানুষ ছোট অপরাধ করেও শাস্তি পায়, তাহলে সে দেশে আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না, গণতন্ত্রও সুরক্ষা পায় না। বাংলাদেশে যদি এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করা যায় যে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, যিনি যত ক্ষমতা ও প্রভাবের অধিকারী হন, আইনের হাত এড়াতে পারবেন না; তাহলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যা, নির্যাতন প্রভৃতি অপরাধ দমনের জন্য সরকারকে নিত্যনতুন আইন করতে হবে না। প্রচলিত আইনই দেশে আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে।
অনেকে বলে, পুলিশ ঘুষ খেয়ে বড় বড় অপরাধীকে ছেড়ে দেয় অথবা পালাতে সাহায্য করে বলে অপরাধ দমন সম্ভব হয় না। এটা হয়তো আংশিক সত্য, সার্বিক সত্য নয়। পুলিশের কাছ থেকে জানা যায়, তারা অপরাধীদের ধরে, কোর্টে চালান দেয়। তারপর একশ্রেণির বড় আইনজীবী তাদের প্রভাবের জোরে মোটা টাকা খেয়ে ওই অপরাধীদের জামিনে মুক্ত করে। মামলায় তারিখের পর তারিখ পড়ে, কোর্টে আর ওঠে না। শেষ পর্যন্ত অপরাধী খালাস পেয়ে যায়। পুলিশের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, অনেক বড় দুর্নীতি ও খুনের মামলায় তারা কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীর নির্দেশে অপরাধীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
বিলাতে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার জন্য প্রিন্সেস অ্যানকে পর্যন্ত জরিমানা দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে মন্ত্রীপুত্র বা কোনো রাজনৈতিক নেতার পুত্র-কন্যাকে পুলিশ ট্রাফিক আইন ভাঙার দায়ে ধরলে তাঁর রক্ষা আছে কি? অনেক বড় বড় আইনজীবী দেশে আইনের শাসন নেই বলে মাঝেমধ্যেই সভা-সমাবেশে অভিযোগ তোলেন। কিন্তু দেশে এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের কোনো ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত উদ্যোগ নেই, একমাত্র সরকারকে দোষারোপের জন্য সভা-সেমিনার করা ছাড়া।
দেশের সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড। এর আগে হানাদারদের সহায়তায় জামায়াতের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। সুদীর্ঘকাল দেশে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় সমাজের সর্বক্ষেত্রেই রাজনৈতিক হত্যাসহ সব ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা দ্রুত বেড়েছে। আমাদের বর্ষীয়ান ও খ্যাত আইনজীবীরা এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার ও অপরাধীদের দণ্ডদানের জন্য আন্দোলন করেছেন কি? এই বিচার বিঘ্নিত ও বিলম্বিত করার ব্যাপারে বিএনপি ও জামায়াত সরকারের কারসাজির কোনো কার্যকর প্রতিবাদ করেছেন কি? বরং মুখ বুজে বিএনপি-জামায়াতের হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি সহ্য করেছেন। তাদের এই নীরবতা ছিল বিএনপি-জামায়াত সরকারের এই বিচার না করার রাজনীতিকে একধরনের অনুমোদন। দীর্ঘকাল পর ক্ষমতায় এসে হাসিনা সরকারকে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড দিতে হয়েছে। এই বিচারের সময়েও একশ্রেণির বড় আইনজীবীর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন বৃহত্তর ক্ষেত্রে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় হাসিনা সরকারের দৃঢ় ভূমিকার পরিচায়ক, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার বিচার এবং রায়ও তেমনি দেশে দ্রুত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারমূলক। হত্যাকারী বা অপরাধী যত বড় উচ্চ আসনেই থাকুন না কেন, আইনের হাত তিনি এড়াতে পারবেন না। এ সত্যটি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে আরো এগিয়ে যেতে হবে। এই এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় একটি বড় ধাপ।