ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি,১৮ জানুয়ারি : নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের বিত্ত-বৈভবের হিসাব নেই। ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে অপরাধীর সম্পত্তি নিয়ে কোনও নির্দেশনা নেই। তারপরও ভিকটিমদের দাবি, এ ধরনের অপরাধীর অপরাধের মধ্য দিয়ে অর্জিত অর্থবিত্ত তার সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। তবে আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের কোনও বিধি নেই। এমনকি জরিমানা আদায়কে আনুষ্ঠানিকতা হিসাবেই দেখা হয়।
একসময় ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করা নূর হোসেনের ছিল বৈধ-অবৈধ অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার। সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়, ট্রাক স্ট্যান্ড, সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং, কাঁচপুরের বালুমহাল, মৌচাক, বিদ্যুৎকেন্দ্র, আদমজী ইপিজেড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার দাপট। এখন আর নূর হোসেনের কোনও দাপট নেই, কিন্তু তার বিপুল সম্পত্তি রয়ে গেছে। এলাকাবাসী বলছেন, নূর হোসেনের এক সময়ের ‘সাম্রাজ্য’ ভেঙে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার বিত্ত-বৈভব কমেনি একটুও। বিপরীতে নিহত স্বজনদের হারিয়ে আজও উঠে দাঁড়াতে পারেনি ভিকটিম পরিবারগুলো।
রবিবার সকালে বহুল আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। এ মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি ৯ আসামির ৭ থেকে ১০ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই র্যাবের সাবেক সদস্য।
নূর হোসেনের সম্পত্তির খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, ঢাকার অভিজাত সব এলাকায় তার ফ্ল্যাট আছে, আছে জমি, বিশাল ব্যাংক ব্যালেন্স। রাজধানীর গুলশান-২এ দু’টি ফ্ল্যাটেরও মালিক নূর হোসেন। বনানী ও ধানমণ্ডিতে আরও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। অন্তত ৫০ বিঘা জমিরও সে মালিক। এছাড়া শিমরাইলে ১১ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ তলা বাড়ি, ১০ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ তলা বাড়ি, আরেকটি ৬ তলা ভবন, রসুলবাগে সাড়ে ৮ কাঠা জমির ওপর ৭ তলা ভবনসহ ৫টি বিলাসবহুল বাড়ি ও ৪টি ফ্ল্যাটের মালিক সে। শিমরাইলের টেকপাড়ার বাড়ির পিছনে প্রায় ৪০ বিঘা জায়গা জুড়ে মৎস্য খামারও আছে তার।
১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক ছিল নূর হোসেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় তার পরিচয় হয় হোসেন চেয়ারম্যান। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরই গা ঢাকা দেয় সে। শুধু বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়াই নয়, সম্পত্তি লুকিয়ে আয়কর ফাঁকি দিতেও সে ছিল সিদ্ধহস্ত।
দুদকের অনুসন্ধানে নূর হোসেনের মোট ৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে পাঁচতলা একটি বাড়ি এবং নূর হোসেন ও তার সন্তানদের নামে এবিএস পরিবহনের ৩০টি বিলাসবহুল বাসের কথা জানা গেছে। একসময় বাসগুলো নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করলেও এখন বন্ধ রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে ওই সব সম্পদের বৈধ কোনও উৎস পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, নূর হোসেনের আয়কর ফাইল অনুসারে তার মোট আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। যেখানে আয়ের উৎস হিসাবে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন জলাশয়ে মাছ চাষ। তবে আয়কর ফাইলে কোথাও তার বাড়ি কিংবা বাসের কথা উল্লেখ নেই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর শাহিদুর রহমান বলেন, রায়ে অনেকসময় অর্থদণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ থাকে। তবে সেটাকে আনুষ্ঠানিকতাই বলা যায়। আমাদের দেশের সাধারণ আইনে এধরনের কোনও বিধি নেই। তার নিজস্ব সম্পত্তির বিষয়ে কিছু করার সুযোগও নেই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, খেয়াল করে দেখবেন, ভিকটিমদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নিহত গাড়িচালক ইব্রাহীমের পরিবারের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ছোট ছোট ৫ সন্তান নিয়ে মা কিভাবে দিনযাপন করছে, সেই খোঁজ রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এধরনের ঘটনায় যারা আসামী, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আর এদের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। নূর হোসেনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে কিছু করার আইন নেই বলা হলেও এই পরিবারগুলোর মধ্যে যাদের চলার সঙ্গতি নেই, তাদেরকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার একটা পদ্ধতি বের করা সম্ভব।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন