রাজধানীর উত্তর বাসাবোয় নিজের বাসায় দুই শিশুকে গলাকেটে হত্যার দায় তাদের মা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। শনিবার ভোরে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তানজিন রহমান এই দায় স্বীকার করেনে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেন সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল কুদ্দুস ফকির।
শনিবার (১৩ আগস্ট) ভোর ৪টার দিকে শিশুদের মা তানজিনা রহমানকে সুবজবাগ এলাকা থেকে আটক করা হয় বলে জানায় পুলিশ। এর আগে শনিবার ভোরে দুই শিশুকে হত্যার ঘটনায় বাদী হয়ে সবুজবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন শিশুদের বাবা মাহবুব রহমান। তানজিনাকে ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে। তবে হত্যার সঙ্গে আর কেউ জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, উত্তর বাসাবোর ১৫৭/২ নম্বর বাসা থেকে শুক্রবার রাতে দুই ভাই-বোনের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাত পৌনে ১০টার দিকে ‘ষড়ঋতু’ নামের একটি ছয়তলা ভবনের চিলেকোঠায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত হুমায়রা বিনতে মাহবুব তাকিয়া (৬) ও মাশরাফি ইবনে মাহবুব আবরারের (৭) বাবা মাহবুব রহমান ওয়াসায় চাকরি করেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
মাহবুব রহমান জানান, তিনি এশার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। বাসায় ফিরে দেখেন, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। পরে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে বিছানার ওপর একজনের এবং পাশের কক্ষে অন্য সন্তানের লাশ দেখতে পান। ওই সময় স্ত্রী তানজিনা রহমান ঘরে ছিলেন না। নিহত দুই শিশু মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতো।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, দুই শিশুকে তাদের মা হত্যা করেছে। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন।
ঢাকা মেট্রাপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মো. মারুফ হাসান বলেন, একটি লাশ বেডরুমের বিছানায়, অন্যটি পাশের রুমে ছিল।
মারুফ হাসান বলেন, মাহবুব রহমান ওয়াসার কম্পিউটার অপরেটর পদে চাকরি করেন। তিনি সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে যান। পরে ফিরে এসে এ অবস্থা দেখতে পান। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একাধিক লোক জড়িত কিনা তা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। শিশুদের মা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তা মোটামুটিভাবে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, বাসা থেকে একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। হয়তো এটা দিয়ে হত্যাকারীরা তাদের হত্যা করতে পারে, আবার নাও করতে পারে। এ বিষয়ে এখনও উপসংহারে আসতে পরিনি।
শিশুদের মা মানসিক রোগী কিনা? সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব রহমান বলেন, তাকে আটক করার পর তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিষয়টি জানা যাবে।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহের জন্য রয়েছে।
জানা যায়, গত আটমাস ধরে তারা ওই বাড়িতে ভাড়া থাকেন। বাড়িটি একবছর আগে তৈরি হয়েছে। নিহত শিশুদের ফুফু লাইলা নূর বলেন, ২০০৮ সালে তাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পরপরই আমরা তার (শিশুদের মা) মানসিক সমস্যা বুঝতে পারি। এরপর ফার্মগেটের গ্রিন রোডের ডক্টরস চেম্বারে ড. আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আমরা তাকে দেখায়। ডাক্তার তার চিকিৎসা করে সব সময় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। শিশুদের মা সবসময় নামাজ রোজা করতেন, কোরআন তেলওয়াত করতেন।
শিশুদের মা কী ধরণের সমস্যায় ভুগছিলেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে লাইলা নূর বলেন, তিনি সাধারণত চুপচাপ থাকতেন, কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতেন না। সন্তান বা স্বামীর প্রতি কোনও খেয়াল রাখতেন না। তবে যখন ওষুধ দেওয়া হতো তখন তিনি ভাল থাকতেন। আর যখন ভাল থাকতেন তখন সমস্যা জানতে চাইলে বলতেন, তিনি (শিশুদের মা) স্বপ্নে তার দুই সন্তানকে মেরে ফেলেছেন বা তার বাবা মা (শিশুদের নানা-নানী) তাকে মেরে ফেলেছে। অথবা তিনি তার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। এসব স্বপ্ন দেখে তিনি দুঃশ্চিন্তা করতেন।
তিনি আরও বলেন, গত ৩ জুন তারা সপরিবারে নারায়ণগঞ্জের আমাদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি সুস্থ ছিলেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদ নগরে। গত ঈদের তারা সেখানে গিয়েছিল।
লাইলা নূর বলেন, নিহত শিশুদের বাবা মাহবুব রহমান দুপুরে কোরবানির বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমরা তিন ভাই-বোন সবসময় এক সঙ্গে কোরবানি দিয়ে থাকি। তখন সে বলেছিল তারা সবাই ভাল আছে। এরপর রাত সাড়ে নয়টার দিকে আমার ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান ফোনে জানায়, তাকিয়া ও আবরার আর বেঁচে নেই। তারপর আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে এখানে ছুটে আসি।
তিনি আরও বলেন, খিলগাঁওয়ের বাগিচা এলাকায় নিহত শিশুদের নানার বাড়ি। তাদের নানা বেঁচে নেই। নানি, মামা ও খালারা সেখানে থাকেন। তাদের বাড়িও কুমিল্লার দেবিদাড়ে।
তিনি বলেন, আবরার গত এক বছর ধরে স্থানীয় একটি মাদ্রায় পড়াশুনা করতো। মেয়েটাও কিছুদিন আগে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়।