হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার পর প্রায় দেড় মাস হতে চললেও স্বাভাবিক চেহারায় ফিরতে পারেনি গুলশান এলাকার রেস্তোরাঁগুলো। দুপুরে বা সন্ধ্যায় যেসব রেস্তোরাঁ অতিথির ভিড়ে সরগরম থাকত, এখনও সেখানে সুনসান নীরবতা।
ক্রেতার অভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে কোনো কোনো রেস্তোরাঁ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। দুশ্চিন্তা ছেঁকে ধরছে ক্যাফে-রেস্তোরাঁর মালিক ও কর্মীদের।
গুলশান নর্থ এভিনিউয়ে অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের সামনেই সলৎজ রেস্তোরাঁ। সোমবার দুপুর ২টায় সেখানে গিয়ে দেখা গেল সবগুলো টেবিল ফাঁকা।
রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম জানালেন, বেলা ১টায় তারা এক তুর্কি নাগরিকের জন্য খাবার পার্সেল করে পাঠিয়েছেন।
“উনি আগে এখানে এসে দুপুরের খেয়ে যেতেন। গুলশান হামলার থেকে আর নিজে আসেন না। মাঝেমধ্যে পার্সেল নেন।”
পুর ২টা। এই সময়ে গুলশানের সলৎজ রেস্তোরাঁ গমগম করত গুলশান হামলার আগে। সোমবার পাওয়া গেল খাঁ খাঁ চিত্র।
রফিকুল ইসলাম জানালেন, তার রেস্তোরাঁর ১৩০টি টেবিল দুপুর বা রাতে দেশি-বিদেশি অতিথিতে ভরা থাকত। গতবছর ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের পর বিদেশি অতিথি আসা কিছুটা কমে যায়। গুলশান হামলার পর বিক্রি একবারে পড়ে গেছে।
উল্টো দিকে গুলশান এভিনিউয়ের ১৮৮ নম্বর হোল্ডিংয়ে মেরাকি রেস্তোরাঁর টেবিলগুলোও দেখা গেল ফাঁকা। সোমবার বেলা আড়াইটায় সেখানে কোনো টেবিলেই কাউকে খেতে দেখা গেল না। ফ্লোর ম্যানেজার মো. কামাল শরীফ জানালেন, দুপুরের পর কেবল একজন অতিথি পেয়েছিলেন তারা।
“গুলশান হামলার পরও কিছু অতিথি আসতো। কিন্তু আইনশৃঙ্খলার যে কড়াকড়ি… এখানে আসতে কয়েক জায়গায় পুলিশ চেক করে। বাড়তি ঝামেলা এড়াতে অনেকেই এখন আর আসেন না।”
ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে আগে গভীর রাত পর্যন্ত প্রাণচঞ্চল্য দেখা যেত। কোনো কোনো রোস্তরাঁ খোলা থাকত রাত ২টা পর্যন্ত। গভীর রাত পর্যন্ত চলত তরুণদের আড্ডা।
কিন্তু হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ অতিথি নিহত হওয়ার পর পাল্টে সেই চিত্র।
পথে পথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি এখন নিরাপত্তার অনুভূতি দিলেও মোড়ে মোড়ে তল্লাশিতে বিরক্ত হয়ে অনেকেই গুলশান এলাকা এড়িয়ে চলেন। ১১৩ নম্বর সড়কের গ্লাসহাউজ ব্রাসেরিতে খেতে আসা এক নারীও নিরাপত্তার কড়াকড়িতে ঝক্কি পোহানোর কথা বললেন।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, গুলশান হামলার পর কয়েকটি চেকপোস্ট বসায় রাস্তায় সময় নষ্ট হয়। খেতে আসার জন্য এত তল্লাশির ঝামেলায় কেউ যেতে চায় না। তবে এ অবস্থা কেটে যাবে বলেই তিনি আশা করছেন।
“এভাবে আতঙ্কজনক অবস্থা চলতে পারে না। তবে এই ভীতিকর অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সময় দরকার। সময়ই পরিস্থিতি ঠিক করে দেবে।”
হোটেল, গেস্টহাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরায় ৬০টি হোটেল-গেস্ট হাউজ এবং প্রায় ৫০০ রেস্তোঁরা আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় এক লাখ কর্মী, যারা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন।
আগে ‘পিক আওয়ারে’ ক্রেতার ভিড়ে দম ফেলার অবসর মিলত না গুলশান দক্ষিণ এভিনিউয়ের ভিলেজ রেস্তোরাঁর কর্মীদের। এখন তাদের কাটাতে হচ্ছে অলস সময়। বিক্রি ৯০ শতাংশ কমে যাওয়ায় সেপ্টেম্বর থেকে ছুটির নোটিস পেয়েছেন তাদের ১৬জন।
ভিলেজ রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রেস্তোরাঁ চালাতে প্রতিদিন তাদের ব্যয় হচ্ছে ৬৫ হাজার টাকা, কিন্তু বিক্রি কমে গেছে ৯০ শতাংশ।
“আমাদের ১৬ জন কর্মীকে সেপ্টেম্বর মাস থেকে নতুন চাকরি খুঁজতে বলেছে মালিকপক্ষ। প্রতিদিন লোকসান দিয়ে তো আর প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব না। এজন্য মালিকপক্ষ এটা করতে বাধ্য হয়েছে।”
সেপ্টেম্বর থেকে ছুটির নোটিস পাওয়াদের একজন এ রেস্তোরাঁর এক্সিকিউটিভ শেফ হারুন মোল্লা। ৩৭ বছর ধরে এ পেশায় থাকা হারুন হঠাৎ করেই অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথাও ভাবছেন।
“খুবই ক্রাইসিসে পড়ে গেলাম। সংসার নিয়ে করা সব ‘প্ল্যান’ ওলটপালট হয়ে গেল। নতুন চাকরি খুঁজছি, কিন্তু এখন তো বাজার ভালো না। নিজে যে কিছু করব তারও উপায় নেই।”
ভিলেজ রেস্তোরাঁর উল্টোদিকে অ্যাবাকাস রেস্তোরাঁর অবস্থাও একই। খালি পড়ে থাকা চেয়ার টেবিল দেখিয়ে ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান চৌধুরী জানালেন, আড়াইশ অতিথির বসার ব্যবস্থা থাকলেও দুপুরের খাবার খেতে এসেছেন মাত্র দশজন।
“লাঞ্চের সময় এখানে তো ভিড় লেগে থাকত। বিদেশিরাও আসতেন। এখন চেয়ার-টেবিল খালি পড়ে থাকে।”
এ রেস্তোরাঁয় ৪০ জন কর্মীর মধ্যেই কাউকে এখনও ছাঁটাই করা না হলেও কতদিন এভাবে চলা সম্ভব হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত নন হাবিবুর রহমান।
“এখনো চাকরি যায়নি বলে যাবে না এমন নয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কয়দিন বসিয়ে খাওয়াবে?”
গুলশান নর্থ এভিনিউয়ের খানা-খাজানা রেস্তোরাঁয় আগে প্রচুর বিদেশি অতিথি আসতেন। সেই চিত্র পাল্টে গেছে গুলশান হামলার পর।
গত ৪ অগাস্ট বেলা ৩টার দিকে সেখানে অতিথি দেখা গেল মাত্র একজন। রেস্তোরাঁর হিসাবরক্ষক শিশির খন্দকার জানালেন, দুপুরে মাত্র পাঁচজন অতিথি খেতে এসেছেন।
“কোনো কোনো দিন কেউ আসে না। রাতে এ সড়ক ভুতুরে এলাকায় পরিণত হয়। অতিথিদের আসার প্রশ্নই আসে না।”
এ রেস্তোরাঁ পরিচালনা করছে নিজাম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির সেক্রেটারি মো. নাজমুল হক জানালেন, ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে তারা কাজ করছেন।
গুলশান ১১৩ নম্বর সড়কের গ্লাসহাউজ ব্রাসেরির ফ্লোর ম্যানেজার রকিবুল হাসান জানান, আগে তাদের রেস্তোরাঁয় বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার অনেক ভিড় থাকত। কিন্তু এখন বিদেশিরা একেবারেই আসেন না। কারও প্রয়োজন পড়লে ফোনে অর্ডার দেয়।
অতিথি কমে যাওয়ায় রেস্তোরাঁর বুফে ডিনার বন্ধ রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের জুলাই মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। এ মাসেও সেভাবে চলছে। এখনও কর্মীদের বেতন দেওয়া হয়নি।”
গুলশানের মেরাকি রেস্তোরাঁর মালিক শাহ আলমের কথাতেও একই রকম হতাশার সুর পাওয়া গেল।
“বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল মাসে এক লাখ টাকা করে দিতে হয়। সব মিলিয়ে খরচ প্রায় বিশ লাখ টাকা। কিন্তু বেচাকেনা না হলে পুরোটাই লোকসান হবে। এভাবে হয়তো এক-দুই মাস চলতে পারব। এরপর হয়তো বন্ধ করে দিতে হবে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে হোটেল-রেস্তোরাঁর অবদান ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট জিডিপির ১ শতাংশের কাছাকাছি।