ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),রাজধানীর প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫ || বৈশাখ ৮ ১৪৩২ :
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন জাহিদুল ইসলাম পারভেজ (২৪)। তার মিডটার্ম পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা শেষে শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় বন্ধু তরিকুল, সুকর্ণ, ইমতিয়াজসহ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে র্যানকন বিল্ডিংয়ের সামনের একটি পুরি-শিঙাড়ার দোকানে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন।
Advertisement
তাদের পেছনেই দাঁড়ানো ছিল ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুজন ছাত্রী। পারভেজ তাদের নিয়ে হাসাহাসি করেছে কি না সেটি জানতে আসেন মেহেরাজ ইসলাম (২০), আবু জহর গিফফারি পিয়াস (২০) ও মাহাথির হাসান (২০) নামের তিনজন। পরে বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। যা দেখা যায় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজেও। পরে এ ঘটনা প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস পর্যন্ত গড়ায়।
শিক্ষকদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি মীমাংসা হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতেই গেটের সামনে পারভেজের ওপর হামলা হয়। তাতে ছুরিকাঘাতে মারা যান প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজ (২৪)।
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পরিবারের স্বজনদের প্রশ্ন, হাসিই কি কাল হলো পারভেজের?
এ ব্যাপারে নিহতের চাচাতো ভাই দেলওয়ার হোসেন বলেন, ময়মনসিংহ ভালুকা বিরুনিয়ায় ছাত্রদল করত পারভেজ। তবে ঢাকায় গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িয়েছিল এমন তথ্য পরিবার জানে না।

তিনি বলেন, ঘটনা যাই ঘটুক দেশে প্রচলিত আইন আছে। ভদ্রতা-সভ্যতা বলে কিছু আছে। শুধু হাসাহাসির জন্য একটা ছেলেকে কেউ এভাবে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করতে পারে না। এ ঘটনায় তিনি জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
নেপথ্যের ঘটনা বা সূত্রপাত যেখান থেকে বলা হচ্ছে সেই কথিত বান্ধবী বা প্রেমিকাকেও আইনের আওতায় আনার দাবি জানান দেলওয়ার।
এ ঘটনায় শনিবার (১৯ এপ্রিল) দিবাগত রাতে নিহতের মামাতো ভাই হুমায়ুন কবীর বাদী হয়ে বনানী থানায় হত্যা মামলা করেছেন। এতে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতসহ আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঘটনার সূত্রপাত যেখান থেকে সেই ‘কথিত প্রেমিকা’ শনাক্ত হলেও মামলায় তার নাম নেই।
মামলার উল্লিখিত আসামিরা হলেন– মেহেরাজ ইসলাম (২০), আবু জহর গিফফারি পিয়াস (২০), মো. মাহাথির হাসান (২০), সোবহান নিয়াজ তুষার (২৪), হৃদয় মিয়াজি (২৩), রিফাত (২১), আলী (২১) ও ফাহিম (২২)। এ ছাড়া অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও ২৫/৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও পারভেজ খুনে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ বলছে, খুনের ঘটনায় ইন্ধনদাতা হিসেবে সেই কথিত প্রেমিকাকে শনাক্ত করা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের ওই ছাত্রীর বিস্তারিত নাম, পরিচয়, ঠিকানা খোঁজা হচ্ছে। সামান্য হাসাহাসির ঘটনায় খুনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা সেই কথিত প্রেমিক আবু জহর গিফফারি পিয়াসকেও শনাক্ত করা হয়েছে। পিয়াসসহ খুনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, হাসাহাসির কারণ জানতে গিয়ে তর্কাতর্কির বিষয়টি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের লেকচারার শুসমা ছোঁয়াতী এবং সাইকোলজি বিভাগের আবুল হাশেমের নজরে এলে তারা উভয়পক্ষকে ডেকে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান।
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে শিক্ষক শুসমা ছোঁয়াতী ও আবুল হাশেম ইংরেজি বিভাগের মশিউর রহমানের মধ্যস্থতায় বিষয়টি মীমাংসা করে দিলে সবাই যার যার মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যায়।
এজাহারে বলা হয়, পারভেজ ও তার বন্ধুরা বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাস্তার ওপর নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাকালে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে উল্লিখিতসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের আসামিরা হাতে ছুরি-চাকু, চাপাতি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে বনানী থানাধীন ১৭নং রোডের প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ধাওয়া করে। দৌড়ে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশকালে মেহেরাজ ইসলাম, আবু জহর গিফফারি পিয়াস ও মাহাথির হাসানসহ অন্যরা পারভেজ ও তরিকুল ইসলামকে ধরে এলোপাথাড়ি মারধর করতে থাকে। একপর্যায়ে আবু জহর গিফফারি পিয়াস ও মাহাথির হাসান পারভেজকে শক্ত করে ধরে রাখে আর মেহেরাজ ইসলাম ছুরিকাঘাত করে। পারভেজের বন্ধু তরিকুল ইসলামকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার উদ্দেশে এলোপাথাড়ি আঘাত করে মাথার মাঝে এবং বাম হাতের কনুইয়ের নিচে জখম করে।
বিষয়টি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ করেন। দুজনকে উদ্ধারের পর সিএনজিযোগে চিকিৎসার জন্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পারভেজকে মৃত ঘোষণা করেন।
Advertisement
মামলার বাদী ও নিহতের চাচাতো ভাই হুমায়ুন কবীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবার হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। চাচা থাকেন কুয়েতে। সন্তানের মৃত্যুর খবরে তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। পরিবারের দুই-ভাই বোনের মধ্যে পারভেজ ছিল বড়। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা দিশাহীন।
তিনি বলেন, ঘটনা পুলিশ জানে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকরা জানেন। ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত সেটা সিসিটিভি ফুটেজে পরিষ্কার। বিশ্বাস করতে চাই স্পষ্ট প্রমাণ থাকায় খুনিরা কেউ পার পাবে না। পুলিশ তাদের প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করবে।
থানা পুলিশ ও মামলা সূত্রে জানা গেছে, ৩নং আসামি মাহাথির হাসানের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ৪নং আসামি সোবহান নিয়াজ তুষার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বনানী থানার যুগ্ম আহ্বায়ক, ৫নং আসামি হৃদয় মিয়াজি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বনানী থানার যুগ্ম সদস্য সচিব, ৬নং আসামি রিফাতের ঠিকানা বনানীর কড়াইল বস্তি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাসেল সারোয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসামিদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তারের স্বার্থে এই মুহূর্তে আমরা বেশি কিছু বলছি না।
ঘটনার সূত্রপাত ও ইন্ধনদাতা হিসেবে কথিত সেই বান্ধবী বা প্রেমিকাকেও শনাক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে বনানী থানার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মামলায় তার নাম না থাকলেও ঘটনার মূলে তার সংশ্লেষের অভিযোগ আসছে। আমরা তা বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করছি। তার ছবি ও নাম পেয়েছি। পরিচয় যাচাই-বাছাইসহ পারিবারিকভাবে তাকে জিম্মায় নিয়ে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর বিবেচনায় ডিবি পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
এ ঘটনায় প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির প্রক্টর মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পারভেজকে কর্মী দাবি করে বিচার দাবি ছাত্রদলের
নিহত প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৩ ব্যাচের টেক্সটাইল বিভাগের ছাত্র পারভেজকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কর্মী বলে দাবি করেছে ছাত্র সংগঠনটি।
এ ঘটনায় হত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছে ছাত্রদল। পাশাপাশি ছাত্রনেতাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব।
রোববার (২০ এপ্রিল) রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দু’তিনজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিঙাড়া খাচ্ছিলেন পারভেজ। এমন সময় মেহেরাজ ইসলাম এবং আরও দুজন ছাত্রীসহ কয়েকজন ওই পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই তারা পারভেজকে উদ্দেশ্য করে ‘এদিকে তাকাচ্ছ কেন?’, ‘এদিকে তাকালে চোখ তুলে দেব’-এ ধরনের মন্তব্য করতে থাকেন। পারভেজ জবাবে বলেন, ‘কি দোষ করেছি ভাই?’ এতে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। বিষয়টি মীমাংসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আব্দুস সালাম হস্তক্ষেপ করেন এবং উভয়পক্ষকে মীমাংসা করে দেন।
Advertisement
তিনি বলেন, প্রচণ্ড উচ্ছৃঙ্খল মেহেরাজ ইসলাম গং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করে দেওয়া এই মীমাংসা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ১০-১৫টি লাশ ফেলার হুমকি দিয়ে বহিরাগতদের ডেকে আনে এবং পারভেজের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালায়। এই হামলায় মেহেরাজ ইসলামের সঙ্গে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী থানা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক শোভহান নিয়াজ তুষার ও যুগ্ম সদস্য সচিব হৃদয় মিয়াজীর নেতৃত্বে এলাকার বেশ কিছু উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী জড়িত ছিল। তারা ছুরি দিয়ে পারভেজের বুকে আঘাত করে হত্যা করে বলে দাবি করেন ছাত্রদল সভাপতি।
সেই ‘কথিত প্রেমিকা’ শনাক্ত হলেও মামলায় নেই নাম
মামলায় আসামি ৮ জন
ছাত্রদলের দাবি, খুনিরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত