ঢাকা: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সদ্য ঘোষিত কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন তাদের নিয়েই আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামতে হবে বিএনপিকে। আগামী দিনে বিএনপির রাজনৈতিক সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করবে কেন্দ্রীয় কমিটির এই নেতাদের রাজনৈতিক মেধা ও গুণগত মানের ওপর।
কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর বনেদিয়ানার বিচারে বিএনপির চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। দলটির মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোও শক্তিশালী।
ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব এবং স্বাধীনতার পর সামরিক-স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে বর্তমান সরকারি দলটি। সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে যারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন বা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তারাই এখনও দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন।
অন্যদিকে স্বাধীনতার পর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিএনপির জন্ম। আন্দোলন-সংগ্রামের সোনালী অধ্যায়ের কোনো অভিজ্ঞতা বিএনপির নেই। স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই আরাম-আয়েসের জীবন কাটান। রাজপথের সংগ্রামে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও অনেকের নেই। কারাভীতি প্রবল থাকায় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে থাকতেও সিদ্ধহস্ত তারা।
তবে এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে বিএনপি নেতাদের। হাতে গোনা দুই-একজন ছাড়া এ ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মুখও বিএনপির নতুন কমিটিতে দেখা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে যারা রয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই ষাট, সত্তর ও আশির দশকের ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগ বা অন্য ছাত্র সংগঠনের প্রভাবশালী নেতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের কর্মী-সংগঠক ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নেতারাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটি এবং আওয়ামী লীগের ১৫ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীতে যারা রয়েছেন তাদের অতীতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ভূমিকা বিশ্লেষণ করলেও তাদের গুণগত মানের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে থেকে রাজনীতি করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক সংকটের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দীর্ঘদিন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি, ডাকসুর ভিপি ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিতে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে বাংলার অগ্নিকন্যা হিসেবে পরিচিতি পান। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য, ছাত্রলীগের বলিষ্ঠ নেতা ছিলেন। জাতীয় চারনেতার একজন ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম এবং নূহ-উল-আলম লেনিনও ছিলেন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তাদের প্রত্যেকের গৌরবোজ্জ্বল অংশগ্রহণ রয়েছে।
ওবায়দুল কাদের সত্তর, আশির দশকে প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং জাতীয় চারনেতার একজন মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও ছাত্র রাজনীতি থেকে এসেছেন। তারাও প্রত্যেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
অন্যদিকে সদ্য ঘোষিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে একমাত্র তরিকুল ইসলাম ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগীর ছাড়া অন্যদের তেমন কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে জিয়াউর রহমানের সময় বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একজন আইনজীবী। জিয়াউর রহমানের বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে তার তেমন কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা নেই। এরপর তিনি এরশাদের জাতীয় পার্টি ঘুরে আবার বিএনপিতে আসেন। জমিরউদ্দিন সরকারেরও বিএনপির রাজনীতি সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা নেই। লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান, আ স ম হান্নান শাহ সেনাবাহিনীতে জিয়াউর রহমানের সহকর্মী এবং এম কে আনোয়ার একজন আমলা ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই অবসরের পর বিএনপিতে যোগ দেন।
তবে তরিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে তিনি চীনপন্থি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাত্রলীগ করেছেন এবং জাসদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। নজরুল ইসলাম খান একজন শ্রমিকনেতা হিসেবে বিএনপিতে আসেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের চীনপন্থি অংশের একজন প্রথম সারির নেতা ছিলেন। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামের ধনী ব্যবসায়ী পরিবার থেকে উঠে আসা।