শাজাহান খানের অবৈধ বাণিজ্য এখনও বহাল (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),রাজনীতি প্রতিনিধি,মঙ্গলবার   ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ||  চৈত্র ২৫ ১৪৩১ :

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান গ্রেপ্তার হলেও চট্টগ্রাম বন্দরে তার অবৈধ বাণিজ্য এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। বন্দরে শিপিং হ্যান্ডলিং অপারেশনের জন্য বৈধ অপারেটর ও ভেন্ডরস অ্যাগ্রিমেন্ট প্রয়োজন হয়। তবে নিয়মের তোয়াক্কা না করে তার বিতর্কিত শিপিং হ্যান্ডলিং অপারেটর প্রতিষ্ঠান ‘জ্যাক শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড’ ঠিকই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা ও নাম পরিবর্তনের অভিযোগ রয়েছে, যা নিয়ে আদালতে মামলা চলমান।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি জাহাজ থেকে আমদানি পণ্য নামানোর (স্টিভিডোরিং) কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি (বিএসটিসি)। ব্যক্তিমালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী চট্টগ্রাম ক্লাবের সাবেক সভাপতি এএ রাজিউল করিম চৌধুরী। ১৯৮৪ সাল থেকে অসুস্থ হওয়ার পর ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০০ সাল থেকে তার স্বাক্ষর জাল করে তার স্টিভিডোরিং প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে প্রথমে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড ও পরে জ্যাক শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড করা হয়। প্রসঙ্গত, অতীতের স্টিভিডোরিং পদ্ধতিকেই বর্তমানে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেশন বলা হয়।

জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করায় প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নিয়ে আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা হয়। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী শাজাহান খান এতে জড়িত থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি তার প্রভাবে আদালতে মামলাটির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতিও হয়নি। ৫ আগস্টপরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান গ্রেপ্তার হলেও চট্টগ্রাম বন্দরে তার দোসরদের দিয়ে ব্যবসা চলছে বহাল তবিয়তে। ব্যবসার টাকার ভাগ এখনও শাজাহান খানের পরিবারের কাছে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো তদন্ত করলে এর প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সিআইডি ও পিবিআইয়ের তদন্তে এএ রাজিউল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া জ্যাক শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেডের ভেন্ডরস অ্যাগ্রিমেন্ট করার কোনো তথ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট বিভাগে নেই বলেও পুলিশকে জানানো হয়েছে। অথচ ভেন্ডরস অ্যাগ্রিমেন্ট ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। তার পরও বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে।

বন্দর সূত্র জানিয়েছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান জ্যাক শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেডের অংশীদার হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে বাধ্য হয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি শাজাহান খান তৎকালীন বন্দর চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগে ওই বছরের ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রীর একান্ত সচিব মো. সোহরাব হোসেন স্বাক্ষরিত একটি ডিও লেটার দেওয়া হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে।

Advertisement

সূত্র জানিয়েছে, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান জ্যাক শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেডের মালিকানার অংশীদার। ফলে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে গেছে কোনো ঝামেলা ছাড়াই। প্রতিষ্ঠানের নাম প্রতিবর্তনে বন্দরের দেওয়া শর্তগুলো পূরণ না করলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। শাজাহান খান বর্তমানে কারাগারে থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ঠিকই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা পরিচালনা করছেন আনোয়ার হোসেন মজুমদার।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠানের পুরো নাম পরিবর্তন হয়েছে অতীতে এমন কোনো নজির নেই। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করলেও মূল নাম পরিবর্তন করতে পারেনি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে শাজাহান খানের দাপটের কারণে সব অবৈধ কাজ সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়ে শাজাহান খানের প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্ব ও মামলা পরিচালনার বিষয়ে জানতে চেয়ে আনোয়ার হোসেন মজুমদারের মোবাইলে ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি তা রিসিভ করেননি।

ভেন্ডর অ্যাগ্রিমেন্ট ছাড়া জ্যাক শিপিং কীভাবে কাজ করে জানতে চাইলে বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম আমাদের সময়কে বলেন, ভেন্ডর অ্যাগ্রিমেন্ট নিয়ে জ্যাক শিপিং আদালতে মামলা করেছে। আদালত যেহেতু নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, তাই তারা কাজ করছে। কোন গ্রাউন্ডে মামলা করেছে জানতে চাইলে এনামুল করিম জানান, ভেন্ডর অ্যাগ্রিমেন্টের শর্ত দেওয়ার বিষয়টিকে তারা চিঠিতে চ্যালেঞ্জ করেছে। এ ধরনের শর্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছে। তাদের দাবির বিষয়ে এনামুল করিম বলেন, তাদের এই দাবি সঠিক নয়; তবে আইনের ফাঁক পেয়ে মামলা করেছে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে আমদানি পণ্য শ্রমিকের মাধ্যমে লাইটার জাহাজে হস্তান্তরের কাজকে স্টিভিডোরিং বলা হতো। বর্তমানে এটি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেশন হিসেবে পরিচিত। আর বন্দরের অনুমোদন নিয়ে পণ্য নামাতে শ্রমিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটিকে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর বলা হয়। বর্তমানে ৩২টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর হিসেবে কাজ করছে বলে বন্দরসূত্রে জানা গেছে।

Advertisement

অভিযোগ আছে, প্রকৃত মালিক যাতে বুঝতে না পারে সে জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি দুইবার নাম পরিবর্তন করে লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছে। সিআইডি ও পিবিআইর পৃথক তদন্তে জাল-জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। রাজিউল করিম চৌধুরীর ছেলে ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোরশেদ আরিফ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, রাজিউল করিম চৌধুরীর মালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি (লাইসেন্স নম্বর ২/১৯৭২, তারিখ ০১.০১.১৯৭২) নামের প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে নাম পরিবর্তন করে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড করে; পরে জ্যাক শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড করা হয়। দুই-দুইবার নাম পরিবর্তন করে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে এএ রাজিউল করিম চৌধুরীকে ১০ শতাংশ শেয়ারও দেওয়া হয়েছে। আবার ওই শেয়ার রাজিউল করিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর জাল এফিডেভিটের মাধ্যম হস্তান্তর দেখানো হয়।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ফাইল ছবি