যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি), আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি,শুক্রবার   ২৮ মার্চ ২০২৫ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩১ :

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বাসিন্দাদের অনেকে তখন গভীর ঘুমে। কেউ কেউ সাহ্‌রির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এমন সময় শুরু হয় একের পর এক বোমা হামলা। ইসরায়েলি বাহিনীর সেই হামলায় হতাহত হতে থাকেন নারী-শিশুসহ সব বয়সী ফিলিস্তিনি। রাতের অন্ধকারে চলতে থাকে আহত রক্তাক্ত মানুষের আর্তচিৎকার আর আতঙ্কিত মানুষের দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি। যুদ্ধবিরতির মধ্যে আবার দুঃস্বপ্নের রাত ফিরে এল ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এ উপত্যকায়।

Advertisement

১৫ মাস ধরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর গাজাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল যুদ্ধবিরতি। ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন করে গাজায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার। গত সোমবার মধ্যরাতের পরে ঘুমন্ত গাজাবাসীর ওপর এই হামলায় অন্তত ৪০৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

গাজার দক্ষিণের খান ইউনিস ও রাফা, উত্তরের গাজা নগর এবং মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহসহ গাজার প্রায় সব জায়গায় যুদ্ধবিমান ও ড্রোন থেকে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলায় অন্তত ৫৬২ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের বর্বরতম এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে গাজার সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। সংগঠনটি বলেছে, এই হামলার মধ্য দিয়ে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছে ইসরায়েল। নৃশংস এ হামলার প্রতিবাদ জানাতে আরব ও ইসলামিক দেশগুলোসহ ‘মুক্ত বিশ্বের মানুষদের’ সড়কে নেমে প্রতিবাদে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে হামাস।

ইসরায়েল দাবি করেছে, হামাস জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়ায় এই হামলা চালানো হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, ইসরায়েল এখন থেকে আরও বেশি সামরিক শক্তি নিয়ে হামাসের ওপর হামলা চালাবে।

হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, গাজায় এ হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করে ইসরায়েল।

যুদ্ধবিরতির মধ্যে গাজায় হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইসরায়েলের হামলা ফিলিস্তিনিদের জীবন অসহনীয় দুর্দশা বয়ে এনেছে। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। দ্বিতীয়ত, গাজায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশে বাধা দেওয়া যাবে না এবং তৃতীয়ত, নিঃশর্তে জিম্মিদের মুক্তি দিতে হবে।’

গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তিতে বলা ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলাকালে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হবে। যদি এর মধ্যেও দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে সমঝোতা না হয়, তাহলে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলবে।

এ ছাড়া প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ২ মার্চ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়ানোর বিষয়ে অনুমোদন দেয় ইসরায়েলের সরকার। পবিত্র রমজান ও ইহুদিদের পাসওভার উৎসব এই মেয়াদকালের আওতায় পড়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে সোমবার রাতে আবারও গাজায় নির্বিচার হামলা চালাল ইসরায়েল।

‘হাতে হাতে শিশুর ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ’

ঘড়িতে তখন রাত ২টা ১০ মিনিট। মেয়ে বানিয়াসকে নিয়ে গভীর ঘুমে মারাম হুমাইদ দম্পতি। আচমকা যুদ্ধবিমান থেকে একের পর এক বোমা হামলার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বানিয়াসের। শিশুটির চোখেমুখে আতঙ্ক। চিৎকার করে কাঁদছিল আর বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘বাবা! মা! কী হচ্ছে বাইরে?’

মারাম হুমাইদ বলেন, ‘মেয়ে শুয়ে ছিল আমার পাশে। তাকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।’

দেইর আল-বালাহর বাসিন্দা মারার হুমাইদ বলেন, ‘এ অবস্থায় মেয়েকে কোলে জড়িয়ে ধরে তার বাবা। হামলার তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে। বুঝতে পারছিলাম আবার ইসরায়েল হামলা শুরু করেছে।’

চারপাশে ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলার শব্দে ঘুম ভাঙে আহমেদ আবু রিজক ও তাঁর পরিবারের। গাজার এই স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। শিশুরাও ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন সড়ক থেকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসতে শুরু করে। দেখলাম লোকজন তাঁদের হাতে করে সন্তানদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ নিয়ে আশপাশের হাসপাতালের দিকে ছুটে যাচ্ছে।’

মোমেন কোরেইকেহ নামে গাজার এক বাসিন্দা বলেন, সোমবার মধ্যরাতে ইসরায়েলের এই হামলায় নবজাতক, নারী-শিশুসহ পরিবারের ২৬ জন সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি।

গাজায় আল-জাজিরার প্রতিনিধি তারেক আবু আজৌম জানান, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অস্থায়ী হাসপাতাল, আবাসিক ভবন—সর্বত্র বিমান থেকে বোমা হামলা চলছিল। হামলায় হামাসের কিছু শীর্ষ নেতাও নিহত হয়েছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধবিমান ও ড্রোন থেকে চালানো হামলার পর নবজাতক, শিশু, নারী ও প্রবীণ মানুষের অসাড় দেহ যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়।’

Advertisement

‘হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী’

হামাস বলেছে, ইসরায়েল এই নৃশংস হামলার মধ্য দিয়ে গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করেছে। ইসরায়েলির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তাঁর চরমপন্থী সরকার যুদ্ধবিরতি চুক্তি উল্টে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গাজায় থাকা (ইসরায়েলি) বন্দীদের জীবনও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে তারা।

গাজার আরেক সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন ইসলামিক জিহাদ বলেছে, যুদ্ধবিরতির সব প্রচেষ্টা ভূলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে এ হামলা করেছে দখলদার ইসরায়েল।

যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গাজায় নতুন করে ইসরায়েলের হামলা শুরুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করেছে ইরান। গতকাল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অব্যাহত হত্যাযজ্ঞের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি দায়ী।’

ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কাতার, সৌদি আরব ও জর্ডান। গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মধ্যস্থতা করে আসা কাতার বলেছে, ইসরায়েলের এ হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্তির ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর বলেছে, ইসরায়েলের এই হামলা যুদ্ধবিরতি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন।

ইসরায়েলের হামলায় চীন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং। সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে এমন পদক্ষেপ না নিতে দুই পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। রুশ সরকারের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’

গতকাল হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলাইন লেভিট ফক্স নিউজকে বলেন, ‘গাজায় আজ (সোমবার) রাতের হামলার বিষয়ে আগেই ট্রাম্প প্রশাসন ও হোয়াইট হাউসের সঙ্গে আলোচনা করেছে ইসরায়েল।’ তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, হামাস, হুতি, ইরানসহ যারা শুধু ইসরায়েল নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও ভীতি ছড়াতে চায়, তাদের এর মূল্য চুকাতে হবে। নরকের সব দরজা খুলে যাবে।’

যুদ্ধবিরতির আলোচনা বন্ধ

কয়েক মাসের আলোচনার পর মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এ চুক্তির আওতায় ৩৮ জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগার থেকে প্রায় ২ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। প্রাথমিক এ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় ধাপে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে কাতারের দোহায় বিবদমান পক্ষের সঙ্গে কাতার ও মিসরের আলোচনা চলছিল। সূত্রের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার রাতের হামলার পর যুদ্ধবিরতির আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে।

দেড় মাস ধরে আলোচনা চললেও যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও গাজা থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে ইসরায়েল রাজি হচ্ছিল না। ইসরায়েল ও তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়িয়ে গাজায় থাকা অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হোক।

কিন্তু হামাস বলে আসছিল, মূল চুক্তি অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপের স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর করতে হবে। এর আওতায় ইসরায়েলি সব সেনাকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। এর পরই বাকি জিম্মিদের ছেড়ে দেবে তারা।

হামাস এখনো মূল যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চলতে চায় বলে গতকাল জানিয়েছেন সংগঠনটির মুখপাত্র আবদেল লতিফ। তিনি রয়টার্সকে বলেন, মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে এখনো তাঁদের যোগাযোগ রয়েছে। এখনো তাঁরা মূল চুক্তি পুরোপুরি কার্যকরের পক্ষে।

Advertisement

 

এদিকে গাজায় হামলার পর ইসরায়েল নিশানা করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করেছে তারা। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেস্তে যাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন ইউরোপের ২৭টি দেশের এই জোটের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজায় হামলা বন্ধ ও ত্রাণসহায়তা প্রবেশ করতে দিতে হবে।

The bodies of victims killed in overnight Israeli airstrikes on the Gaza Strip are carried on stretchers at Al-Ahli Arab hospital, also known as the Baptist hospital, in Gaza City ahead of their burial on March 18, 2025. Israel on March 18 unleashed its most intense strikes on the Gaza Strip since a January ceasefire, with rescuers reporting 220 people killed, and Hamas accusing Benjamin Netanyahu of deciding to “resume war” after a deadlock on extending the truce. (Photo by Omar AL-QATTAA / AFP)