ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),মো. ইব্রাহীম খলিল মেঘনা থেকে,বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪ || অগ্রহায়ণ ১২ ১৪৩১ :
গ্রামের খোলা মাঠ। সোনালি ধানের ক্ষেত। নরম রোদ আর হালকা বাতাসে ভাসছে হুক্কার ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ধোঁয়ার মাঝে যেন ভেসে উঠছে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতি। বয়স্ক এক ব্যক্তি হুক্কা হাতে বসে আছেন, পাশে এক তরুণ তার পাশে হাসিমুখে বসে আড্ডায় মগ্ন। এ যেন এক চিরচেনা গ্রামীণ জীবনের ছবি, যেখানে সময় থমকে থাকে, আর স্মৃতিরা ফিরে আসে নীরব সাক্ষী হয়ে।
Advertisement
গতকাল ফেসবুকে একটি ছবি দেখে মনটা আটকে গেল। এক বয়স্ক মানুষ হুক্কা হাতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়ছেন। ছবিটা দেখে মনে হলো, যেন আমাদের গ্রামের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো চোখের সামনে ফিরে এসেছে। ছোটবেলায় দাদার সঙ্গে বসে হুক্কার গল্প শুনেছি। সেই স্মৃতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।
বাংলার গ্রাম্য জীবনে হুক্কা শুধুই একটি ধূমপানের যন্ত্র নয়, এটি ঐতিহ্যের অংশ, গল্পের সঙ্গী। একসময় প্রায় প্রতিটি ঘরে থাকত একটি হুক্কা। বাড়ির উঠানে, ধানের খেতে কিংবা গ্রামের বিভিন্ন গাছের নিচে জড়ো হতেন গ্রামের মানুষ। সেখানে চলত জমজমাট আড্ডা। নানা বয়সের মানুষ একসঙ্গে বসে গল্প করতেন, হাসতেন এবং জীবনের দুঃখ-সুখ ভাগ করে নিতেন। হুক্কা যেন সেই আড্ডার প্রাণ।
এই ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে, তিনি আমাদের চোখে তুলে ধরছেন এক অনন্য ঐতিহ্য। সাদা পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক মানুষটির চোখে-মুখে জ্ঞানের দীপ্তি। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়তে ছাড়তে হয়তো তিনি মনে করছেন তার নিজের অতীতের কথা। মনে করছেন, কেমন করে তার দাদা-নানারা ঠিক একইভাবে ধোঁয়া ছেড়ে ছেড়ে জীবনের গল্প বলতেন। পাশে বসে থাকা তরুণটির মুগ্ধতা সেই উত্তরাধিকারেরই অংশ।
এই দৃশ্য শুধু একটি মুহূর্ত নয়, এটি সময়কে ধরে রাখা এক ফ্রেম। তরুণের মুখের হাসি আর বয়স্ক ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ছাপ যেন গ্রামীণ জীবনের দুই প্রান্তকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। এটি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, প্রজন্মের ব্যবধান হয়তো একটি বাস্তবতা, কিন্তু শেকড়ের গল্পগুলো কখনোই পুরানো হয় না।
হুক্কার ধোঁয়া আমাদের শুধু স্মৃতিকাতর করে না, এটি আমাদের মাটির টানকেও মনে করিয়ে দেয়। শহরায়নের স্রোতে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে-হুক্কার জায়গায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তবুও গ্রামীণ জীবনে এখনো এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্য। তারা জানেন এই হুক্কা শুধু ধোঁয়ার বাহন নয়, এটি একটি মেলবন্ধনের মাধ্যম।
Advertisement
হুক্কা নিয়ে বাঙালির গল্প বহু পুরনো। কেউ বলে, এটি এসেছে মধ্য এশিয়া থেকে। আবার কেউ বলে, এটি মিশেছে বাংলার মাটির সঙ্গে আমাদের দাদা-নানাদের হাত ধরে। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে তারা যেমন জীবনের ক্লান্তি মিশিয়ে দিতেন, তেমনই খুঁজে পেতেন প্রশান্তি। হুক্কার ধোঁয়া যেন জীবনের ছোটখাটো সমস্যাগুলোকেও ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে দিত।
তাছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছে বার্তা ছবির এই তরুণটির মতো আজকের প্রজন্মের কাছে হুক্কা হয়তো অদ্ভুত বা অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু এটি কেবল একটি যন্ত্র নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতির গল্প, আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনের ছোঁয়া।
আজকের ব্যস্ত জীবনে, যেখানে মানুষ মুঠোফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্দি, সেখানে এই হুক্কার ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে ফিরে আসে আন্তরিকতা। এই দৃশ্য যেন মনে করিয়ে দেয়, জীবনের প্রতিটি ছোটখাটো আনন্দ কতটা মূল্যবান। হুক্কার ধোঁয়া আর খোলা আকাশের নিচে আড্ডা ছিল একসময়কার বেঁচে থাকার সহজ আনন্দ।
গ্রামের গাছপালা, সোনালি ধান আর হুক্কার ধোঁয়ার মতো দৃশ্যগুলো আমাদের স্মৃতির আকাশে চিরকাল বেঁচে থাকবে। এ দৃশ্য শুধু এক ব্যক্তির নয়, এটি আমাদের সকলের গল্প। যারা এই দৃশ্য দেখবেন, তারা হয়তো তাদের দাদার কথা মনে করবেন, সেই পুরনো দিনের কথা। নতুন প্রজন্মের উচিত এই ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করা, কারণ এই শেকড়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের পরিচয়।
শুধু হুক্কার ধোঁয়া নয়, সেই ধোঁয়ার সাথে জড়িয়ে থাকা জীবন, স্মৃতি আর সম্পর্কের মাধুর্যই আমাদের এই গল্পের আসল নায়ক।