ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বগুড়ার দুপচাঁচিয়া প্রতিনিধি, মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪ || অগ্রহায়ণ ৪ ১৪৩১ :
স্ত্রীকে হারানোর পরদিনই মাকে হত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে ছেলেকে। এক দিনের ব্যবধানে এমন দুটি ঘটনায় ভেঙে পড়েন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা মসজিদের খতিব আজিজুর রহমান। কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না তার শান্তশিষ্ট ছেলেটি নিজের মাকে হত্যা করতে পারে।
Advertisement
বারবার চাইছিলেন স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য উদঘাটন হোক। এজন্য র্যাব ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুই সংস্থাকেই ভাড়াটিয়া মাবিয়া সুলতানার কথাও বলেছিলেন। পুলিশ মাবিয়াসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর হত্যারহস্য নতুন মোড় নেয়।
শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) রাতে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানান আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গত ১১ নভেম্বর স্ত্রী উম্মে সালমার জানাজার পর আমাকে ও ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানকে র্যাব তাদের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এরপর সাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন আমি পাশের কক্ষেই ছিলাম। সাদকে অনেক টর্চার করা হয়। হয়তো এ কারণেই সে মাকে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছিল।’
মাবিয়ার বিষয়ে আজিজুর রহমান বলেন, ‘ওই নারী চার-পাঁচ মাস আগে আমার বাড়ি ভাড়া নেয়। শুরু থেকেই তার আচরণ আমাদের কাছে ভালো লাগেনি। আমার স্ত্রী গত সপ্তাহে বলেছিল, ওকে রাখা যাবে না। আমি তাকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। সে সময় চেয়েছিল।
‘এরই মধ্যে একদিন আমার স্ত্রীর সঙ্গে মাবিয়ার ঝগড়া হয়। সে সময় আমার স্ত্রী তাকে বলেছিল, আপনি চলে যান। আপনার ভাড়া দেওয়া লাগবে না। পরবর্তীতে মাবিয়া আমার স্ত্রীকে হুমকি দেয় সে জোর করে এই বাসায় থাকবে, তাকে বের করা যাবে না।’
Advertisement
আজিজুর রহমান বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগেও আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল, সে (মাবিয়া) যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। আমি তাকে বের করে দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছিলাম। কিন্তু, তার আগেই এই নৃশংস ঘটনা ঘটে গেল।’
মাবিয়াসহ আরও দুই যুবক তার স্ত্রীকে হত্যা করে বলে পুলিশের কাছ থেকে জেনেছেন আজিজুর রহমান। পুলিশের কাছে তাদের স্বীকারুক্তির সূত্রে আজিজুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে মাবিয়া বাসায় ঢোকে, পরে দুই যুবক কক্ষে প্রবেশ করে। আমার স্ত্রী তখন তরকারি কাটছিল। তারা প্রথমে আমার স্ত্রীর নাকে স্প্রে করে। এতে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে হাত-পা বেঁধে ডিপ ফ্রিজের ভেতরে রেখে দেয়।’ আজিজুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার পর র্যাব তদন্তে এলে মাবিয়ার বিষয়টি বলি। পরে পুলিশকে জানাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুই সংস্থাকেই বলেছি, হত্যার আসল রহস্য বেরিয়ে আসুক। এতে যদি আমার ছেলে অপরাধ করেছে প্রমাণিত হয়, তাহলে তার শাস্তি হবে। কিন্তু নিরপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায়।’
ছেলে সাদের বিষয়ে আজিজুর বলেন, ‘র্যাব যখন সম্মেলন করে জানাল, সাদ তার মাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। আমরা খুব অবাক হয়েছি। এ ঘটনায় আমার ছেলের ও আমার ব্যাপক সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আমার ছেলের মানসিক অবস্থা এখন কী একমাত্র সেই বলতে পারবে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে হত্যাকাণ্ডে সাদের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি।’
এ বিষয়ে জানতে র্যাব-১২ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর এহতেশামুল হক খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বগুড়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন রঞ্জন সরকার বলেন, ‘উম্মে সালমা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে মোসলেম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মাবিয়া সুলতানা ও সুমন রবিদাস তালুকদার জবানবন্দি না দেওয়ায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করা হয়েছে।’
গত রোববার (১০ নভেম্বর) দুপুরে দুপচাঁচিয়া উপজেলার জয়পুরপাড়া এলাকায় ‘আজিজিয়া মঞ্জিল’ নামের বাড়ির একটি ফ্ল্যাটের ডিপ ফ্রিজ থেকে গৃহবধূ উম্মে সালমার (৫০) মরদেহ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরদিন উম্মে সালমা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তার ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানকে (১৯) গ্রেপ্তার করে র্যাব। তার পরদিন দুপুরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র্যাব-১২ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর এহতেশামুল হক খান সাংবাদিকদের জানান, তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় নিহতের স্বামী আজিজুর রহমান, ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানসহ আরও একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব অফিসে ডাকা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সাদ তার মাকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।
হত্যার কারণ হিসেবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে প্রেমঘটিত বিষয় এবং হাতখরচের টাকার জন্য সাদ তার মাকে হত্যা করে বলে তারা জানতে পেরেছেন।
এদিকে, পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সময় ওই বাসা থেকে খোয়া যাওয়া ওয়াইফাই রাউটার এবং মোবাইলের সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে ভাড়াটিয়া উত্তর সাজাপুর গ্রামের আইয়ুব আলীর স্ত্রী মাবিয়া বেগম (৫০), তার সহযোগী গুনাহার ইউনিয়নের তালুচ পশ্চিমপাড়ার আব্দুর রহিমের ছেলে মোসলেম উদ্দিন (২৬) ও একই এলাকার নিখিল রবিদাসের ছেলে ভ্যানচালক সুমন রবিদাসকে (২৮) গ্রেপ্তার করে।
Advertisement
দুপচাঁচিয়া থানার পুলিশ জানায়, তারা প্রথমে আটক করেন ভাড়াটিয়া মাবিয়া আক্তারকে। মাবিয়া পুলিশকে জানান, চার মাস আগে উম্মে সালমার ওই বাসা ভাড়া নিয়ে তিনি এখানে মাদক ও অনৈতিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি টের পাওয়ার পর উম্মে সালমা ও তার স্বামী আজিজুর রহমান তাকে এক মাস ধরে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলছিলেন। তার কাছে দুই মাসের ভাড়াও পাওনা ছিল। বিষয়গুলো নিয়ে মাবিয়া বাড়ির গৃহকর্ত্রী উম্মে সালমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই তিনি তার সহযোগী ও মাদক ব্যবসায়ী সুমন রবিদাস এবং মুসলেমকে নিয়ে গত শনিবার উম্মে সালমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।