ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রতিনিধি ,শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪ || অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১ :
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় চাঁদ ডাইং কারখানার মালিক, শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তার কথিত প্রেমিকা রুমা আক্তার (২৮) ও রুমার বান্ধবী রোকসানা রুকু (২৬)।
Advertisement
শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) বিকেলে ১৬৪ ধারায় দেয়া দুজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন নারায়ণগঞ্জ আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হায়দার আলী।
লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়ে সব তথ্য স্বেচ্ছায় ও অকপটে আদালতের বিচারকের খাস কামড়ায় স্বীকার করেন রুমা ও রুকু। রাতে আদালতে দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. কাইউম খান।
তিনি বলেন, পরকীয়া প্রেমিকা রুমা ও তার বান্ধবী রুকু ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। পরে আদালতের নির্দেশে আসামিদের জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
এর আগে বুধবার (১৩ নভেম্বর) সকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপশহরের লেকের পাড় থেকে কালো রঙের তিনটি পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমের মরদেহের ৭ টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় ও বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে তদন্তের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে জেলা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা।
শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কাফরুল থানার শেওড়াপাড়া এলাকায় মাসুমের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে রুমা ও রুকুসহ ৪ জনকে আটক করে জেলা পুলিশ। পরে রূপগঞ্জ থানায় পরিবারের দায়ের করা হত্যা মামলায় রুমা ও রুকুকে গ্রেফতার দেখিয়ে অপর দুজনকে ছেড়ে দেয়া হয়।
এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় তদন্তের দায়িত্বে যুক্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হত্যার পর কাফরুলের শেওড়াপাড়ার বাসায় ছিলেন রুমা। কোনো ধরনের টেনশন ছাড়াই চলাফেরা ও ঘুমাতে থাকেন তিনি। বুধবার (১৩ নভেম্বর) রাতে পুলিশ তাকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ঘটনার সবকিছুই অকপটে স্বীকার করেন রুমা। পরদিন রুমা ও তার বান্ধবী রুকুকে গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এনে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতার দুই নারী স্বেচ্ছায় আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মত হন।
জবানবন্দিতে রুমার দাবি, কাফরুলের তিনটি কক্ষের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে তার ছোট বোন, বান্ধবী, ভাবী ও তার বাচ্চা বসবাস করেন। জসিম উদ্দিন মাসুম গত ১০ নভেম্বর ওই বাসায় আসার পর দুধের সঙ্গে চেতনানাশক দ্রব্য মিশিয়ে তাকে অচেতন করা হয়। এ অবস্থায় দুই দিন ওই বাসায় রাখা হয় তাকে। মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) একটি কক্ষের বাথরুমে নিয়ে জসিম উদ্দিন মাসুমকে হত্যার পর লাশ চাপাতি ও হেক্সো ব্লেড দিয়ে ১১ টুকরো করা হয়। পরে রুমা তার এক বন্ধুকে দিয়ে কালো রঙের বড় তিনটি পলিথিনের ব্যাগ আনিয়ে সেই ব্যাগগুলোর ভেতরে মরদেহের সাত টুকরো সিএনজিতে করে কুড়িল বিশ্ব রোড ৩০০ ফুট সড়কের রূপগঞ্জের পূর্বাচলে একটি লেকের পাড়ে এবং অন্য চারটি অংশ পাশের একটি কাশবনে ফেলে দিয়ে আসেন রুমা। রুমাকে গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে তাকে নিয়ে পুলিশপূর্বাচলে গেলে তার দেখানো মতে কাশবন থেকে জসিম উদ্দিন মাসুমের দেহের আরও চারটি অংশ উদ্ধার করে পুলিশ। হাত, পা ও কোমর থেকে বুকের খণ্ডিত অংশ ছিল পরবর্তী উদ্ধার হওয়া দেহাংশের।
হত্যাকাণ্ডের পর ব্যবহৃত চাপাতি, হেক্সো ব্লেড ও নিহত জসিম উদ্দিন মাসুমের পরনের পোশাক রাজধানীর বনানীর ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসায় রেখে আসেন রুমা। পরে ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে সেগুলো জব্দ করা হয়।
Advertisement
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রুমা স্বীকার করেন, শিল্পপতি মাসুমের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল দীর্ঘদিন ধরে। জসিম উদ্দিন মাসুম একপর্যায়ে রুমাকে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। সম্প্রতি মাসুম অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এতে মাসুমের ওপর রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা ও আবেগের বসে পরিকল্পিতভাবে তাকে খুন করেন রুমা।
রোববার (১০ নভেম্বর) বিকেলে মাসুম তার বাসা থেকে বের হয়ে গুলশান গিয়ে ব্যাংক থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা তোলেন। পরে তিনি অন্য গাড়িতে করে নারায়ণগঞ্জে ডাইং কারখানায় যাবেন বলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও চালককে বাসায় ফিরে যেতে বলেন। সেদিন রাতে মাসুম বাসায় ফিরে না আসায় এবং তার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় পরদিন সোমবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর গুলশান থানায় নিখোঁজের জিডি করেন বড় ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু।
এরপর বুধবার (১৩ নভেম্বর) সকালে রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন-কুড়িল বিশ্বরোড সড়কের পূর্বাচল উপশহরের লেকের পাড় থেকে তিনটি পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মরদেহের সাত টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই জিডির সূত্র ধরে এবং প্রযুক্তির সহায়তায় তদন্ত করে পুলিশ নিশ্চিত হয় উদ্ধার করা মরদেহের টুকরোগুলো ফতুল্লার শিল্পপতি মাসুমের। খবর পেয়ে স্বজনরা সদর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন।
শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমের গাড়িচালক আবদুল মালেক জানান, ‘নদী জলে শাপলা ভাসে’সহ দুটি সিনেমার প্রযোজনা করেছেন মাসুম। সিনেমা জগতে বিচরণ করতে গিয়ে অনেক নায়ক-নায়িকার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এর সূত্র ধরেই গত প্রায় এক বছর আগে অবিবাহিতা রুমা আক্তারের সঙ্গে পরিচয় ও পরবর্তীতে অল্পদিনেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে রুমাকে কাফরুলের শেওড়াপাড়ায় ওই ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া করে দেন মাসুম। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত সেই ফ্ল্যাটে যাতায়াত করতেন।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রুমার ভাষ্যমতে, শিল্পপতি জসিমের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাকে নায়িকা করা এবং বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাসুম। সে কারণে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. তরীকুল ইসলাম সময় সংবাদকে জানান, গ্রেফতার রুমা আক্তার ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুর থানার তারাকান্দা এলাকার নজর আলীর মেয়ে। তিনি নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও কম্পিউটার কাজে বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। রাজধানীর বনানী এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন এ অবিবাহিতা নারী। গত ঈদুল ফিতরের সময় ঢাকায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শিল্পপতি জসিম উদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং অল্পদিনেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে।
মামলার অপর আসামি রুমা আক্তারের বান্ধবী রোকসানা রুকু ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া থানার কানিকশালগাঁও গ্রামের মৃত আবদুল হকের মেয়ে। তিনি মডেলিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।
Advertisement
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জসিম উদ্দিন মাসুম নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা থানাধীন সস্তাপুর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। সেখানে চাঁদ ডাইংসহ তার তিনটি ডাইং কারখানা ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রায় দশ বছর ধরে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাস করছিলেন জসিম উদ্দিন মাসুম।
আসামি রুমা আক্তার ও তার বান্ধবী রোকসানা রুকু। ছবি:ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)