ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),খুলনা প্রতিনিধি, বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ || কার্তিক ১৪ ১৪৩১ :
খুলনার জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরী ব্যাংক কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামী হয়েও অফিস করছেন নিয়মিত। আর পুলিশ বলছে হত্যা মামলার প্রধান আসামী পলাতক রয়েছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।গত ১৯ জুন কুষ্টিয়ার চেচুরিয়া ছোট কেনাল ব্রীজে প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরীর অফিসিয়াল গাড়ীর ধাক্কায় ঘটনাস্থলে ব্যাংক কর্মকর্তা কামরুল হাসান অনু নিহত হয়। এ ঘটনায় নিহতের পিতা মো: ইয়াছিন আলী বাদী হয়ে প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরীকে প্রধান আসামী করে ২জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
Advertisement
এদিকে, হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে চাজর্শীটে অব্যাহতি (ফাইনাল রিপোর্ট) পেতে নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরী অনৈতিক লেনদেন ও হুমকি-ধামকিসহ ব্যাপক তদ্বির চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী। এতে নিহত ব্যাংক কর্মকর্তার পিতা ন্যায় বিচার পাবেন কিনা তা নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় পড়েছেন। তিনি ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের জন্য সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং পুলিশের আইজির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মামলার এজাহার ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, খুলনার জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরী অফিসের গাড়ী নিয়ে প্রতি সপ্তাহেই নিজের গ্রামের বাড়ী পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুরের মহিষখোলা গ্রামে যান।এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১৯জুন অফিসিয়াল সরকারি পাজেরো জীপ (নং-খুলনা মেট্রো-ঘ-১১-০১১৯) নিজেই ড্রাইভ করে গ্রামের বাড়ী থেকে খুলনায় ফিরছিলেন। পথে কুষ্টিয়ার চেচুরিয়া ছোট কেনাল ব্রীজের উপরে মালবোঝাই ট্রাকের সাথে দুর্ঘটনা ঘটে।এ সময় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরী অফিসিয়াল সরকারি গাড়ীটি একটি মোটর সাইকেল (কুষ্টিয়া-ল-১৩-৪৮২৫)কে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে মোটর সাইকেলের দুই আরোহী পাবনার আতাইকুলা উত্তরা ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা কামরুল হাসান অনু ঘটনাস্থলে নিহত ও তার সহকর্মী মোজাফর আলী গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা দুজনকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তা অনুকে চিকিৎসক মৃত ঘোষনা করে।ঘটনার দিন রাতে নিহতের পিতা ইয়াসিন আলী বাদী হয়ে প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরীকে প্রধান আসামী করে দুইজনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা (নম্বর-২৩ তারিখ-১৯/২৪) দায়ের করেন। এই মামলার তদন্তভার পান কুষ্টিয়ার চৌড়হাস হাইওয়ে থানার ওসি আকুল চন্দ্র বিশ্বাস। দুর্ঘটনার কবলিত খুলনা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের পাজেরো জীপ, ট্রাক ও মোটর সাইকেল জব্দ করে কুষ্টিয়া হাইওয়ে থানার পুলিশ।
মামলার বাদী ও দুর্ঘটনায় নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা কামরুল হাসান অনুর পিতা মো: ইয়াছিন আলী অভিযোগ করে জানান, ‘প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরী সরকারী গাড়ী নিজে চালাতে গিয়ে চাপা দিয়ে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। থানায় মামলা করলেও তদন্তকারী অফিসার হাইওয়ে থানা পুলিশের ওসি আমাদের কথা শুনছেন না। দায়সারা তদন্ত করে হত্যাকারী প্রকৌশলী মাহবুব চৌধুরীকে বাঁচনোর চেষ্টা করছে। বিচারের বিষয় কোন কথা বলতে গেলে উল্টো হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। প্রধান আসামী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরী অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে চার্জশীটে নিজের নাম বাদ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পুলিশের র্কমকান্ডে মনে হচ্ছে ছেলে হত্যার ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবো। এদিকে, মামলার তদন্ত কাজ শেষ করে র্চাজশীট আদালতে দাখিলের বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। হাইওয়ে থানা পুলিশ আসামীকে গ্রেফতারের প্রচেষ্টার কথা বললেও অদৃশ্য কারনে আসামী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরীকে গ্রেফতার করছে না। ছেলে হত্যার ন্যায় বিচারের জন্য আমি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং পুলিশের আইজির হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
গত বুধবার ও বৃহষ্পতিবার খুলনা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অফিসে গিয়ে জানা গেছে, পুলিশের খাতায় পলাতক আসামী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরী অফিস করছেন। তিনি এ সময় বলেন তিনি উচ্চ আদালত থেকে অগ্রীম জামিন নিয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চ আদালতের দেয়া জামিনের সময়সীমা শেষ হলেও তিনি জামিনের শতর্মোতাবেক নিন্মআদালতে আত্নসর্মপণ করে স্থায়ী জামিন নেননি। তিনি অফিসের কাজ করছেন এবং হাজিরা খাতার স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে তিনি কিছুই বলতে রাজি হননি।
অন্যদিকে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের একাধিক অফিসার ও কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিনা অনুমতিতে কর্মস্থল থেকে অন্য জেলায় সরকারি গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, সরকারি ড্রাইভারকে বাদ রেখে র্নিবাহী প্রকৌশলীর নিজে গাড়ী চালনো এবং হত্যা মামলার আসামী হলেও র্নিবাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরীকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কৈফিয়ত তলব কিংবা জবাবদিহিতার আওতায় আনেনি। এমনকি পরবর্তীতে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ীটির মেরামতও সরকারী টাকায় করা হচ্ছে। যা অনৈতিক ও বেআইনী। এছাড়াও একজন হত্যা মামলার আসামী ও পুলিশের হিসেবে পলাতক আসামী তিনি কিভাবে সরকারী অফিসে কাজ করেন সেটি কারোর বোধগম্য নয়।
কুষ্টিয়া সদর মডেল থানার ওসি মো: মাহফুজ আলম জানান, গাড়ী র্দূঘটনার পর সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। পরে সেটি চৌড়হাস হাইওয়ে থানার হস্তান্তর করে ওসিকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মামলার বিষয়ে তদন্ত ও র্চাজশীট তারাই প্রদান করবেন।
কুষ্টিয়ার চৌড়হাস হাইওয়ে থানার ওসি ও তদন্তকারী অফিসার আকুল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, মামলার প্রধান আসামী র্নিবাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহমুদ চৌধুরীকে আটক করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তিনি পলাতক রয়েছেন। তাকে পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্ত সম্পন্ন ইতিমধ্যে করা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চার্জশীট আদালতে দাখিল করা হবে। তবে তিনি মামলা তদন্তে প্রভাব বিস্তার করতে অনৈতিক লেনদেন ও তদ্বিরের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
খুলনার জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহবুব চৌধুরী জানান, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অফিসিয়াল গাড়ী অন্য জেলায় বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া অন্যায় হয়েছে। অসাবধানতা বশত: গাড়ীতে একটি র্দূঘটনা ঘটেছে এবং একজন মারা গেছে এটা সত্য। মামলার পর আদালত আমাকে জামিন মঞ্জুর করেছেন।কিন্তু সময়সীমা শেষে আর জামিন নেয়া হয়নি। হত্যা মামলার আসামী ও পুলিশের কাছে পলাতক থেকেও কিভাবে অফিস করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তার কিছুই বলার নেই বলে জানান। তিনি বলেন, বাদী পক্ষের সাথে কথা হচ্ছে বিষয়টি মিমাংসা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দ্রুতই বিষয়টির সমাধান হবে বলেও তিনি জানান। তিনি এসব বিষয় নিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ না করতে এ প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন।
হাইওয়ে পুলিশ খুলনা রিজিওনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো: শাহিনুর আলম জানান, আমি মাদারীপুর রিজিওনের হলেও খুলনা রিজিওনের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। কুষ্টিয়ায় র্দূঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তা নিহতের বিষয়টি আমার পুরোপুরি জানা নেই। ঘটনাটি জেনে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটি-সুজনের আহবায়ক এ্যাড. কুদরত ই-খুদা বলেন, সরকারী গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে সরকারের র্অথের অপচয় করে অনিয়ম ও দূর্নীতি করেছে। সেইসাথে সরকারী গাড়ী নিজে ড্রাইভ করে র্দূঘটনায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে হত্যা করে গুরুতর অপরাধ করেছে। এক্ষেত্রে পুলিশের উচিত ছিল নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহবুব চৌধুরীকে গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করা। এমনকি সরকারী গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা অপচয় করার অপরাধে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরও দায় রয়েছে। এখানে সংশ্লিষ্ঠ সবার বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তর্পূবক ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তিনি দাবী করেন।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য(প্রশাসন ও অর্থ) কাজী আতিয়ুর রহমান বলেন, অফিসিয়াল গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা অন্যায়। এরপরেও তিনি নিজেই ড্রাইভিং করছিলেন যেটা অবশ্যই অপরাধ। খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহবুব চৌধুরীর বিরুদ্ধে দূঘর্টনা ও হত্যা মামলার কারনে তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে অন্য একজনকে পদায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, অফিসিয়াল গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার ও সরকারী র্অথ ব্যয় এবং অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত র্পূবক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব ও পরিচালক (প্রশাসন-র্অথ) মো: হেলালুজ্জামান সরকার জানান, অফিসিয়াল গাড়ী নিয়ে র্দূঘটনার বিষয়ে অবহিত আছি। কিন্তু যেহেতু খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী ব্যক্তিগত কাজে গাড়ী ব্যবহার করে গাড়ীটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাই অফিসিয়াল টাকায় মেরামতের কোন সুযোগ নেই। হত্যা মামলার আসামী হিসেবে অবশ্যই তাকে আইন মোকাবেলা করে তবেই অফিসে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে কথা বলে ব্যক্তিগত কাজে গাড়ী ব্যবহার করে অর্থের অপচয়, অনিয়ম ও র্দূনীতি করে থাকলে খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ মাহবুব চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।