ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,সাংবাদিক ইব্রাহীম মেঘনা থেকে ,বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ :
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
Advertisement
জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্যাকমো পদে প্রায় একযুগ ধরে কর্মরত রয়েছেন। এই সুবাদে তিনি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে রোগীদের বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানোসহ কমিশন বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। কমিশনের লোভে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করাচ্ছেন তিনি। এমনকি নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে রোগীদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে আনতে বাধ্য করা হয় বলে জানা যায়।
বেশ কিছুদিন আগে তানহা ও সাবিহা নামের দুইজন রোগীকে মানিকারচর বাজারে অবস্থিত একটি প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসতে বলেন সাইফুল ইসলাম, যদিও এই পরীক্ষাগুলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করা যেতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী বলেন, “আমি কয়েকদিন আগে আমার বাচ্চাকে নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাইফুল ডাক্তারকে দেখাই। তিনি আমার বাচ্চাকে অনেকগুলো পরীক্ষা দিয়ে ইসলামিয়া জেনারেল হাসপাতাল থেকে করে আনতে বলেন। তখন আমি বললাম, এই জায়গায় হয় না? তিনি উত্তরে বলেন ‘না’। এর আগেও আমার বাচ্চাকে তার কাছে দেখিয়েছি, তখনও বাইরে থেকে করে আনতে বলেছিলেন। আমরা সাধারণ মানুষ খুব বিপদে আছি।”
Advertisement
কয়েকমাস আগে মো. সাখাওয়াত হোসেন নামের একজন ব্যক্তি তার বোনের বুকের ব্যথার জন্য রাত ১০টা বা ১১টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে দায়িত্বরত সাইফুল ইসলাম তার বোনকে দেখে চারটি পরীক্ষা দিয়ে মানিকারচর থেকে করিয়ে নিয়ে আসতে বলেন। তখন রোগীর ভাই পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট এনে জরুরি বিভাগে দেখান। ঠিক ওই সময়ই আরেকজন চিকিৎসক অপর একজন রোগীকে দেখছিলেন। ওই চিকিৎসক কিছু টেস্ট দিয়ে বলেন, এগুলো হাসপাতালেই করাবেন। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমি মিলিয়ে দেখলাম একই টেস্ট। যদি অন্য ডাক্তার টেস্টগুলো এখানেই করতে বলেন তাহলে সাইফুল আমাকে বাইরে থেকে করিয়ে নিয়ে আসতে বললো কেন? এই হয়রানির শেষ কোথায়?”
এলাকার ভুক্তভোগী আরও কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, আমাদের মেঘনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাইফুল ইসলাম নামে একজন ডাক্তার জরুরি বিভাগে ডিউটি চলাকালীন সময়ে বেশিরভাগ রোগীকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করানোর জন্য বাইরে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে হয়তো তিনি কমিশন পাচ্ছেন, তা না হলে বাইরে পাঠাবেন কেন? বাইরে পাঠালে তো লাভবান হবে আশপাশের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের মালিকেরা। আর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো আমাদের মতো গরিবরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন চিকিৎসক এই প্রতিনিধিকে বলেন, “সাইফুল ইসলাম এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত। তিনি দায়িত্বরত অবস্থায় মেডিকেল অফিসারদের জরুরি বিভাগ থেকে বের করে দিয়ে বলেন, ‘স্যার বাইরে থেকে ঘুরে আসেন’। তারাও এই সুযোগে বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেন এবং ভাবেন সাইফুল ইসলাম তাদেরকে কাজে সহযোগিতা করছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শর্ট স্লিপে রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে প্রাইভেটে পাঠিয়ে দেন তিনি। যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করা যায় সেগুলোও বাইরে থেকে করিয়ে আনতে বলেন সাইফুল ইসলাম।”
কয়েকজন সচেতন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করলে তারা বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিবছর চিকিৎসার পেছনে রোগীদের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, তাতে অন্য কোনো উপজেলায় এত ব্যয় হতে দেখা যায় না। কারণ তার বড় একটা অংশই চলে যায় রোগ নির্ণয় করতে। এসব রোগ নির্ণয়ে বেশিরভাগই ব্যয় হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আর এই অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রধান কারণ হিসেবে তারা দায়ী করছেন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সাইফুলের মতো অসাধু উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণকে। সরকারিভাবে এই সমস্ত চিকিৎসক সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরেও ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছেন এসব অনৈতিক চর্চা। এ অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকরা লাভবান হলেও চিকিৎসার উচ্চ ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমায় পৌঁছেছে এ উপজেলার বাসিন্দারা।
তারা আরও জানান, এক শ্রেণির নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত অর্থলোভী চিকিৎসকদের মতো সাইফুল ইসলাম কোনো অংশে কম নয়। তিনি বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে গোপন চুক্তির ভিত্তিতে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর কমিশন গ্রহণ করছেন বলে আমরা শুনতে পাচ্ছি। তার এই কমিশন গ্রহণের বিষয়টি এখন সমালোচনায় রূপধারণ করেছে, যা মেঘনাবাসীর জন্য লজ্জাজনক।
উল্লেখ্য, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে।
অভিযুক্ত সাইফুল ইসলামের সঙ্গে এ বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি ইমোশনাল হয়ে বলেন, “আমি কখনোই নাম উল্লেখ করে কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগী পাঠাই না। আমার নামে যা শুনছেন এগুলো মিথ্যা। মাঝেমধ্যে দুই-একটা পাঠিয়ে থাকলেও আর কখনো নাম বলে পাঠাব না। আমি আজ থেকে নতুন জীবন শুরু করলাম। আমি কোনো ভুল করে থাকলে আমার বিচার করবেন।”
Advertisement
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সায়মা রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, “সে শর্ট স্লিপে কিছুই লিখতে পারবে না। তবে প্রেসক্রিপশন করতে পারবে। আর যদি ডাক্তার তাকে অনুমতি দেয় তাহলে সে শর্ট স্লিপেও লিখতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, “আমি বিষয়টি শুনলাম, আপনি প্রমাণ দিন। আমি তার বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।