ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,বিশেষ প্রতিনিধি , শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১ :
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-দক্ষিণ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিলেন খুবই আলোচিত ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পস্ন্যাটফর্মে তার প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে রুখে দিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ওই দিন তিনি ঘাড়ে গামছা নিয়ে অবস্থান করছিলেন গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসের সামনে। ওইদিন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ঘাড়ে গামছা রাখার রহস্য কী? জবাবে তিনি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, বিএনপি নেত্রী ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র জন্য জনগণকে আহ্বান করেছেন, তাই ভয়ে বাসা থেকে গামছা নিয়ে এসেছি, যদি পালাতে হয়, তাহলে গামছা পরে পালাব। সরকার পতনের পর ঢাকাইয়া এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে আলোচনা। সেই আলোচনায় ঘুরে ফিরে একটি প্রশ্নই- মায়া চৌধুরী এখন কোথায়? এ নিয়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাজপথের আনাচে-কানাচে চলছে নানারকম মুখরোচক গল্প। কেউ বলছেন, তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন, কেউ বলছেন, তিনি দেশেই আছেন, কেউ কেউ বলছেন, তিনি বিএনপির কোনো নেতার শেল্টারে আছেন।
Advertisement
সূত্র মতে, সাবেক মন্ত্রী মায়া চৌধুরী দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলায় ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়েও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহারে খালাস পান। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনীত হন। ফৌজদারি মামলায় কেউ দুই বছর বা এর অধীক দন্ডপ্রাপ্ত হলে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন মর্মে উচ্চ আদালতের রায় থাকলেও সরকার দলীয় ক্ষমতাবলে মামলা থেকে খালাস নিয়ে চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-দক্ষিণ) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য বনে যান। এর আগে ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। মন্ত্রিত্ব পেয়ে তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে চালান অসহনীয় মাত্রায় দুর্নীতি ও লুটপাট। গড়ে তুলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ মার্ডারের মূল হোতা ছিলেন মায়া চৌধুরীর জামাতা তৎকালীনর্ যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার তারেক সাঈদ। হাসিনা সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেই ৭ মার্ডার পুনঃতদন্ত হবে বলেও জানা গেছে। এছাড়াও মায়ার ক্ষমতাকে পুঁজি করে তার দুই ছেলে প্রয়াত দিপু চৌধুরী ও রনি চৌধুরী গড়ে তুলেছিলেন অপরাধের সাম্রাজ্য। রাজধানীতে হত্যা, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অনেক অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
প্রয়াত দীপু চৌধুরীর নেতৃত্বে এক সময় উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব দখলে ছিল। ওই ক্লাবের আধিপত্য ও জমি দখল নিয়ে ২০০০ সালের দিকে তিতাস নামের একজনকে হত্যা করা হয়। দীপু চৌধুরী এ হত্যাকান্ডে জড়িত বলে অভিযোগ ছিল। তখন দীপু চৌধুরীসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তারপরও দীপু ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দীপুকে রক্ষা করেন তখনকার প্রতিমন্ত্রী বাবা মায়া চৌধুরী। এ ছাড়াও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর উত্তরায় ঠিকাদার তরাজউদ্দিন খুনের ঘটনায় মায়ার প্রয়াত ছেলে দীপু চৌধুরীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দীপু চৌধুরী ও তার ছোট ভাই রনি চৌধুরী আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। পাল্টে যায় দৃশ্য পট। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো অল্প সময়েই বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়ে যান তারা। তাদের বোনের স্বামী তারেক সাঈদর্ যাবে থাকার সময় তাকে ব্যবহার করে দীপু ও রনি অনেক কাজ করিয়ে নেন। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের পর দীপু ও রনিকে জড়িয়ে তখন অনেক খবরও প্রকাশিত হয়েছিল।
মায়া চৌধুরীর সংসদীয় আসন চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-দক্ষিণ) এর মানুষগুলো ছিল তার পরিবারের (চৌধুরী পরিবার) কাছে জিম্মি। সাধারণ মানুষের জমি দখল থেকে শুরু করে, চাঁদাবাজি, হত্যা, গুম এমনকি অপহরণের মতো জঘন্য কাজও করত মায়া বাহিনী ও তার পরিবার। মতলব উত্তরে আলোচিত লিয়াকত হত্যা মামলার সঙ্গে মায়ার সম্পৃক্ততা ছিল বলে অভিযোগ উঠে। মায়া ক্ষমতায় থাকাকালীন তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করত না। কথা বললেই শিকার হতে হতো হামলা-মামলার। এই পরিবারের আরেক সদস্য মায়া চৌধুরীর নাতি মাহি চৌধুরী। তার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় বিশাল ক্যাডার বাহিনী। মায়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললেই তার ওপর চলত মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। মায়া মতলবে এতটাই ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন যে, সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীও তার অন্যায় সিদ্ধান্তের বাহিরে কথা বলতে পারতেন না। তার সিদ্ধান্তেই নির্বাচিত হতো উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধি। জানা যায়, ২ কোটিতে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ১ কোটিতে ইউপি চেয়ারম্যান বানাতেন তিনি। এছাড়াও দলীয় পদ-পদবি বিক্রির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মায়া তার নির্বাচনী এলাকা মতলব উত্তর-দক্ষিণে তার ও তার পরিবারের একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের মামলা দিয়ে কোণঠাসা করে রাখতেন। সঠিকভাবে করতে দেননি তাদের দলীয় কোনো কার্যক্রম।
Advertisement
মায়া বাহিনীর নির্যাতনের শিকার সাবেক ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি আশরাফুর রহমান বাবু বলেন, আমি বিএনপির রাজনীতি করার কারণে মায়া বাহিনী আমার বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে জেলে পাঠিয়েছে। আমাকেসহ বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে হয়রানি করেছে মায়া বাহিনী। তিনি বলেন ‘আমরা প্রতিহিংসামূলক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, আমি বিএনপির রাজনীতি করি এটা আমার অপরাধ নয়, একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকবে, ভিন্ন মতাদর্শীয় লোক থাকবে, তাই বলে ভিন্ন রাজনৈতিক দল ভিন্ন মতাদর্শীয় লোকের উপরে কেন এমন হামলা ও মামলা হবে। মায়া বাহিনী মতলবে তাদের একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিএনপির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের উপরে যে নির্যাতন চালিয়েছে এ দেশের জনগণ তাদের বিচার করবে।’
অভিযোগ রয়েছে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের যে সিন্ডিকেট রয়েছে তার মূল হোতা সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী দীপু মনি ও মায়া চৌধুরী। অবৈধ বালু উত্তোলনে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার রায় থাকা সত্ত্বেও দীপু মনি ও মায়া চৌধুরী অবাধে মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করাতে থাকেন। তারা দু’জন এমন বিশাল সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন যে কোনোভাবেই অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি, হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। মেঘনায় এই অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে মেঘনা-ধনাগদা সেচ প্রকল্পসহ ৬৮ কিলোমিটারের মতলব উত্তরের বেড়িবাঁধ।
Advertisement
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী দীপু মনি গ্রেপপ্তার হলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাহিরে মায়া। বিভিন্ন সূত্র বলছে, মায়া দেশেই আত্মগোপনে কোথাও পালিয়ে আছেন। বিশ্বস্ত একসূত্র বলছে, দুর্নীতির মাধ্যমে মায়া যে অর্থ লুটপাট করেছে সেগুলো তিনি আগেই দেশের বাহিরে পাচার করে দিয়েছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর মায়াসহ আওয়ামী লীগের অনেক এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে পুনরায় দুদুকে মামলা হয়েছে। এ ছাড়াও মতলব উত্তরে মায়ার বিরুদ্ধে একাধিক মামলার খবর পাওয়া গেছে। মায়ার সব অবৈধ সম্পদের দেখভাল করেন তার পিএস মামুন। বর্তমানে মামুনও আত্মগোপনে আছেন। এ পরিস্থিতিতে মতলববাসী স্বস্তিতে ফিরলেও তাদের প্রশ্ন কোথায় আছেন মায়া।