ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,বিশেষ প্রতিনিধি, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ ভাদ্র ১৪৩১ :
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সারাদেশের পরিবহন খাত। বেশির ভাগের দখল নিয়েছেন বিএনপিপন্থিরা। পিছিয়ে নেই জামায়াতে ইসলামীও। দলটির লোকজন কিছু কিছু এলাকায় বিএনপির সঙ্গে ‘ঐক্য’ গড়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন। পরিবহন শ্রমিক ও চালকদের দাবি, চরম নৈরাজ্যের অবসান হয়েছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও চাঁদাবাজি চলছেই।
Advertisement
রংপুরে চাঁদাবাজির হাতবদল
রংপুর নগরীর গুপ্তপাড়ায় জেলা পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ে আসছেন না সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মোজাম্মেল হক। সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান রাঙ্গা লাপাত্তা। বর্তমানে দেখভাল করছেন যুগ্ম সম্পাদক আফতাবুজ্জামান লিপ্পন। কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে রংপুর মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় দখলে নিয়েছে বিএনপিপন্থিরা। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়া জেলা শ্রমিক দলের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, বেশির ভাগ নেতা পালিয়েছেন। ফলে আমাকেই সংগঠন দেখতে হচ্ছে। চালক ও শ্রমিকরা জানান, আওয়ামী লীগের পতনে চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে মাত্র। বিএনপির লোকজন পকেট ভরছেন।
রাজশাহীতে দখল নিয়ে কোন্দল
সরকার পতনের পর কমিটি বিলুপ্ত করেন রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সভাপতি নাজিমউদ্দীন। নিজেকে আহ্বায়ক ঘোষণা করেন বিএনপিপন্থি গৌতম মৌহন চৌধুরী। নগর বিএনপির সাবেক সদস্য নজরুল ইসলাম হেলাল সাধারণ সম্পাদক মতিউল হকের কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়েছেন জানিয়ে কার্যালয়ে যান। সেখানে দু’পক্ষের সংঘর্ষে পিছু হটে গৌতমের অনুসারীরা। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত শ্রমিক নেতা রফিক আলী পাখি। তাঁর দাবি, ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন তাঁকে বসিয়েছেন।
মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, নতুনরাও চাঁদাবাজি করছেন। চাঁদাবাজি থামাতে মালিক সমিতি স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছে। নজরুল বলেন, ঢাকার কোচ থেকে আগে ৬০০ করে নিলেও এখন তা ৭০ টাকায় ঠেকেছে।
Advertisement
বগুড়া বাস-মিনিবাস ও কোচ পরিবহন মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মঞ্জু সরকার, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শানবীর আহম্মেদ শয়ন ও পরিচালনা কমিটির সদস্য ফজলুর রহমান তালুকদার বিএনপি করেন। আর উপদেষ্টা হিসেবে আছেন ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামায়াত নেতা এরশাদুল বারী। আগের সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজামান
ডিউক ও সম্পাদক উপজেলা যুবলীগ নেতা আমিনুল ইসলাম আত্মগোপনে।
খুলনায় দখলে কৌশলী বিএনপি
সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে চারটি মালিক সমিতির দুটির নেতৃত্বে পরিবর্তন হয়েছে। সড়কে চাঁদাবাজি থামেনি। ২০০৯ সালে খুলনা বিভাগীয় বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির দখল নেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ও মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আনিসুর রহমান পপলু। তারা শীর্ষ দুটি পদে বসেন। ৫ আগস্ট সমিতির দখল নিয়ে আগের নেতারা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বর্তমান সভাপতি মোকাম্মেল হোসেন ও সম্পাদক রবিউল করিম বিএনপির।
১৫ বছর আগে রূপসা-বাগেরহাট বাস-মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতি থেকে বিএনপি নেতাদের হটিয়ে দখল নেন আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক লিপন ও মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক। এখন সমিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন রূপসা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুর রহমান।
খুলনা মোটর বাস মালিক সমিতি ও আন্তঃজেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা আবদুল গফফার বিশ্বাস। সরকার পরিবর্তন হলেও কমিটি বদলায়নি। আগের মতোই চাঁদাবাজি চলছে। খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের আওয়ামী লীগপন্থি নেতারা পালিয়ে গেছেন।
বিএনপির কবজায় বরিশালের দুই টার্মিনাল
বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় ও রূপাতলী বাস টার্মিনালে দাঁড়ালে স্টাফ ফির নামে চাঁদা আদায় বন্ধ হয়ে গেছে। টার্মিনাল দুটি নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক সিটি মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকনের অনুসারী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অসীম দেওয়ান ও শ্রমিক নেতা সুলতান মাহমুদ। আওয়ামী লীগপন্থিরা এখন আসছেন না।
৫ আগস্টের পর বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ারের ভাই টার্মিনাল দুটি দখলের চেষ্টা করলে বাধা দেয় দলে তাঁর বিরোধীরা। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত কেউই প্রকাশ্যে দখল নেননি। তবে আড়ালে থেকে সরোয়ারের ভাই মোশারফ হোসেনই কলকাঠি নাড়ছেন। একই কৌশলে রূপাতলী টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। তিনি এখন বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির আহ্বায়ক। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী বিএমএফ পরিবহনের দখল নিয়েছেন মোশারফের অনুসারী বিএনপি নেতা বাবলা, ছাত্রদল নেতা নাদিম মাহমুদ ও শামীম।
চট্টগ্রামে আওয়ামীপন্থিরা আত্মগোপনে
চট্টগ্রামের আওয়ামীপন্থি পরিবহন মালিক নেতাদের অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত দখলের মতো ঘটনা ঘটেনি। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা নানাভাবে চাঁদা আদায় করছেন। তবে নিয়ন্ত্রণ নিতে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন বিএনপিপন্থিরা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, আতঙ্ক থেকে পরিবহন মালিকদের কেউ কেউ আত্মগোপনে আছেন। আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা বলেন, অটো টেম্পো ও হিউম্যান হলার থেকে প্রতিদিন ৩০ টাকা নেওয়া হয়।
ময়মনসিংহে নেই চাঁদাবাজি
সরকার পতনে ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরের পরিবহন খাতের চিত্র বদলে গেছে। নগরীর শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ মোড়, ঢাকা বাইপাস মোড়, আকুয়া বাইপাস মোড়, ঢাকা-ময়মনসিংহ বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ থাকায় বিরাজ করছে স্বস্তি। এদিকে ৩৩ বছর পর ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর টোল আদায়ও বন্ধ রয়েছে।
আকুয়া বাইপাস মোড়ে চাঁদা আদায়কারী এক শ্রমিক নেতা বলেন, র্যাব একাধিকবার অভিযান চালিয়ে চাঁদা আদায়কালে ২০ জনকে আটক করে। ভয়ে এখন কেউ চাঁদা তুলছেন না।
সিলেটে দখলে সমঝোতা বিএনপি-জামায়াতের
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, ট্রাক-পিকআপ মালিক সমিতি, জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রাক-পিকআপ-ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাস মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন, সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে আগের কমিটি। কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত মালিক-শ্রমিকরা। জেলা পরিবহন বাস মালিক সমিতিও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
জানা গেছে, সিলেট-বিশ্বনাথ-জগন্নাথপুর-লামাকাজী-টুকেরবাজার মিনিবাস ও কোস্টার মালিক গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবেক বিএনপি নেতা সুহেল আহমদ চৌধুরীসহ অন্যরা সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নিতে মাঠে নেমেছেন।
২০২৩ সালের ৩০ জুন আওয়ামী লীগের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর আট মাস সময়ে কদমতলী বাস টার্মিনাল ইজারা নেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ সেলিম আহমদ। গত ১৪ আগস্ট থেকে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন তারা। সেখানে সমঝোতার ভিত্তিতে যুক্ত হয়ে বিএনপি ও জামায়াতের লোকজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ওরফে ইরান দেশ বাংলা পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান। ফার্মগেট এলাকার লেগুনার নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাতে ছিল। পুলিশের সাবেক আইজি এ কে এম শহীদুল হকের ভাই এ কে এম ইসমাইল হকের পরিবহন কোম্পানির নাম গ্লোরী এক্সপ্রেস। তিনি শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নড়িয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
Advertisement
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতা বদলের পর অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরিবহন খাতের কার্যালয় দখলের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। আর চাঁদাবাজির কারণেই পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা, বাড়তি ভাড়ার নৈরাজ্য। এর মূল ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ। তিনি আরও বলেন, ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের সংস্কার। ক্ষমতা পরিবর্তনের পরই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছাত্র–জনতার লক্ষ্যের বিপরীত। এভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কারণে অতীতে দেখা গেছে পরিবহন খাতের নেতারা সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী মনোভাব দেখিয়েছেন। ফলে এই খাতের বিশৃঙ্খলা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।