ভ্যানের ওপর লাশের স্তূপের ভিডিও নিয়ে তোলপাড় তদন্ত করছে পুলিশ ॥ প্রাথমিকভাবে জড়িতরা চিহ্নিত (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,বিশেষ প্রতিনিধি ,রোববার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭ ভাদ্র ১৪৩১ 

দাঁড়িয়ে আছে একটি রিক্সা ভ্যান। তাঁর চারপাশ ঘিরে পুলিশ সদস্যদের নানামুখী তৎপরতা। কোন কোন পুলিশ সদস্যের এলোমেলো হাঁটাচলা। এর মধ্যেই একটি লাশ উপুড় হয়ে পড়ে আছে রাস্তার ওপর। নিথর সেই দেহটি তোলার চেষ্টা করছেন একাধিক পুলিশ সদস্য। প্রথম দফায় রিক্সা ভ্যানের ওপর লাশটি তুলতে ব্যর্থ। দ্বিতীয় দফায় ওই দুই পুলিশ সদস্যই একটু সজোরে লাশটি উঁচুতে উঠিয়ে ভ্যানের ওপর ফেললেন। যারা ফেলেছেন লাশটি তাদের কয়েকজনের গায়ে পুলিশের ভেস্ট ও মাথায় পুলিশের হেলমেট। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত না হলেও হাত দেখে অন্তত ৩ ব্যক্তি বুঝা যায়। রঙ্গিন ফুলের চাদর দিয়ে দেহগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে- এমন দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘটনাস্থল অজ্ঞাত হিসেবেই ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিও নিয়ে দেশ বিদেশে তোলপাড়। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাস্থল  ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনের সড়কের। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সেখানেরই।

Advertisement

ভিডিওতে দেখা যায়, নিথর দেহের স্তূপবোঝাই ভ্যানটির পাশে কয়েকজন পুলিশ সদস্য হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এদের মধ্যে দুজনের মুখ দেখা গেছে। একজন পুলিশের ভেস্ট পরা, আরেকজন ছিলেন সাদা পোশাকে। পুলিশের ভেস্ট পরা ব্যক্তি হলেন ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। আর সাদা পোশাকের ব্যক্তির পরিচয় মেলেনি। বাকিরাও ডিবি পুলিশের সদস্য হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটির ওপর আরেকটি রক্তাক্ত লাশের স্তূপ সাজাচ্ছেন মাথায় হেলমেট ও ভেস্ট পরিহিত কয়েকজন পুলিশ সদস্য। একপর্যায়ে লাশগুলো ঢেকে দেওয়া হয় চাদর ও রাস্তার পাশের ব্যানারে। চাদর ও ব্যানারের আড়াল থেকে তখনও দেখা যাচ্ছে নিথর হাত-পা। এমন বীভৎস ও লোমহর্ষক ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন আলোচনায়। শিহরে উঠছেন সবাই।

১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওটির ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে দেয়াল দেখা যায়, যেখানে সাঁটানো ছিল একটি পোস্টার। সেটি আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেন ভুঁইয়ার বলে শনাক্ত হয়েছে।

গতকাল শনিবার দৈনিক সংগ্রাম এর সাভার ও আশুলিয়া সংবাদদাতা পৃথকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিডিওতে থাকা সেই দেয়াল ও পোস্টার খুঁজে পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন। এতেই ভিডিওটির ঘটনাস্থল নিশ্চিত হয়েছে। তাদের বর্ণনা মতে, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক থেকে যে সংযোগ সড়ক আশুলিয়া থানাকে সংযুক্ত করেছে এটি মূলত সেই সড়ক। মহাসড়ক থেকে থানার দিকে যাওয়ার সময় পোস্টারসম্বলিত সেই দেয়ালটি হাতের ডানেই পরে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ভিডিওটি আশুলিয়া থানা ভবনের সামনের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে ধারণ করা হয়েছে।

Advertisement

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্ট সকাল থেকে আশুলিয়া থানা এলাকায় অবস্থান করছিল ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি পুলিশের একটি টিম। ওইদিন সকাল থেকেই আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল মোড় এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। সেদিনই বাইপাইল এলাকায় প্রায় সারাদিন মুহুর্মুহু গুলীর শব্দ শোনা যায়।

এ বিষয়ে জানতে ঢাকা উত্তর ডিবির পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, ‘আরাফাতের ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর আরাফাত ভেঙে পড়েছেন। আমরা সেদিন ছাত্র-জনতার দিকে লক্ষ্য করে গুলী ছুড়িনি।’

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈন বলেন, ‘ভিডিওটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। আমাদের টিম কাজ করছে এটি নিয়ে পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ৫ আগস্ট পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলী চালিয়েছে। থানার আশপাশে অনেকে গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। একটি পুলিশের গাড়িসহ কয়েকজন গুলীবিদ্ধকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।

আশুলিয়া থানার সামনের দোকানি ফাহিমা বলেন, আমরা ভিডিওটি দেখেছি। ভিডিওটি আমাদের আশুলিয়া থানার সামনে থেকেই করা। আমরা সেদিন ভয়ে দোকান বন্ধ রেখেছিলাম। আশুলিয়া থানার পাশেই কিছু বালু ভর্তি ব্যাগ ছিল, যা ভিডিওতে দেখা গেছে।

আরেক দোকানদার মনোয়ার বলেন, গত ৫ তারিখে আমার দোকান বন্ধ ছিল। পরদিন ৬ তারিখে সকালে আশুলিয়া থানার সামনে এসে দেখি পুলিশ ভ্যানে কয়েকটা পোড়ানো লাশ। তবে লাশের সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে পারিনি। আর ভ্যানে লাশের স্তূপের ভিডিওটা আশুলিয়ার থানার সামনের।

সেদিন যা ঘটেছিল : ৫ আগষ্টের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, গত ৫ আগষ্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপর বাইপাইল এলাকার বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে বিকেলে উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করেন। এতে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। থানার আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা থানার গেইট বন্ধ করে দেন। তখন বিকেল সাড়ে ৪টার বাজে। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলেন। তারা থানা ভবনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেইট ভাঙতে এগিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। গুলী লোড করতে বলেন। এই কথা শুনে  উপস্থিতরা আরও চড়াও হন। আশপাশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেইটে অবস্থান নেন। বিকেল ৪টা বেজে ৪০ মিনিট। ওসি সায়েদ আহমেদ গেইটে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। তখন ঘটনাস্থলে থাকা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রজনতা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান। একপর্যায়ে এসআই মালেক, ডিবির ওসি তদন্ত আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলী ছোড়েন। গুলীতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলীবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুর্মুহু গুলীতে লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যান।

থানার সামনের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনা স্বচক্ষে দেখা রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, বিকেলে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলী ছোড়ে। এতে থানার গেইটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলী চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেরিয়ে আসেন। তারা গুলী করতে করতে বেরিয়ে আসেন।

ওইদিন ঘটনাস্থলে থানা রকি আহমেদ নামের এক পোশাক শ্রমিক বলেন, পুলিশ প্রথমে গেইটে এসেই ইসলাম পলিমারস এন্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের সামনে পড়ে থাকা গুলীবিদ্ধ ৭ জনকে একটি প্যাডেল  ভ্যানে তুলেন। পরে তাদের থানার সামনে আনেন। পরে লাশগুলো থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয়া হয়। ৭ জনের লাশ আগুনে পুড়িয়ে থানা থেকে সব পুলিশ বেরিয়ে থানা গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। আর গুলী ছুড়তে থাকেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনের হাতে তখনো হাতকড়া ছিলো।

লাশের স্তূপ করা জায়গাটি হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আসলাম হোসেন বলেন, ভাল করে দেখেন। ভিডিওতে যে পোস্টারটি দেখা যাচ্ছে। সেটা এখনো দেয়ালে অক্ষত আছে। কিছু বালুর বস্তা ছিলো সেগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেদিন পুরো থানা রোডেই লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। পুলিশ ভ্যান নিয়ে সব লাশ এক জায়গায় জড়ো করে। আম টোকানোর মত করে পুলিশ গলি দিয়ে লাশ টুকিয়েছে। পরে লাশগুলো থানার সামনে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনা দেখেনি আশপাশে এমন কোনো মানুষ ছিলো না। এ এক ভয়ানক ঘটনা। মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে।

Advertisement

জানতে চাইলে পুলিশের আইজি ময়নুল ইসলাম গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমরা এই লোমহর্ষক ঘটনাটি দেখেছি। কারা কিভাবে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সাথে জড়িতদেরকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে ফেলেছি। এর সাথে আরও কারা জড়িত, তাদেরকে বের করা হচ্ছে। এই ঘটনায় কাদের ভূমিকা কি ছিল তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, নিহতদের যে ছবি দেখা যাচ্ছে মূলত তারা ছাত্রই বলে মনে হয়েছে। তাই যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। তাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে বলে উল্লেখ করেন আইজিপি ময়নুল ইসলাম।