পাকিস্তান কালী মায়ের মন্দির! দেবী কালাটেশ্বরী (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,পাকিস্তান প্রতিনিধি ,শুক্রবার, ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১৫ ভাদ্র ১৪৩১ 

রূপাঞ্জন গোস্বামী পাকিস্তানে জাগ্রত কালী মায়ের মন্দির! অনেকটা চাঁদে মানুষের বসতি থাকার মতোই অবাস্তব লাগে শুনতে। পাকিস্তানে থাকা বেশির ভাগ হিন্দু মন্দিরের আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে রয়ে গিয়েছে এক প্রাচীন কালী মন্দির

Advertisement

 

পাকিস্তানে জাগ্রত কালী মায়ের মন্দির! অনেকটা চাঁদে মানুষের বসতি থাকার মতোই অবাস্তব লাগে শুনতে। পাকিস্তানে থাকা বেশির ভাগ হিন্দু মন্দিরের আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে রয়ে গিয়েছে এক প্রাচীন কালী মন্দির। প্রায় দু’হাজার বছর ধরে সেই ভূখণ্ডে বিরাজ করছেন মা কালী। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার সময় অবশ্য পাকিস্তান বা বালোচিস্তানের নাম গন্ধ ছিল না। পাকিস্তানের খনিজ পদার্থ সম্বৃদ্ধ প্রদেশ বালোচিস্তানের বুকে আছে কালাট নামে এক শহর। সেই শহরের প্রাণকেন্দ্রে আছে এই কালী মন্দির। যে মন্দিরে আজও মা কালীর পূজা হয় মহাসমারোহে। কালাট শহরের এই রণচণ্ডী, উগ্রমূর্তি দেবীকে সমীহ করে পুরো পাকিস্তান। সদা ক্রোধান্বিতা, রণরঙ্গিনী, করাল-বদনা দেবীর নাম কালাট কালী মাতা, কেউ ডাকেন ‘মা কালাটেশ্বরী’ বলে। ‘মা’ এখানে পূজিত হচ্ছেন কয়েক হাজার বছর ধরে। সেই ৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। মন্দিরের দ্বারে উর্দু ভাষায় সালটি সুষ্পষ্টভাবে লেখাও আছে।

 বালোচিস্তানের কালাট শহর।

মন্দিরের ভেতরে আছে মা কালাটেশ্বরীর প্রায় কুড়িফুট উঁচু বিগ্রহ। ভক্তদের আতিশয্য থেকে বিগ্রহকে আলাদা রাখার জন্য বিগ্রহটি কাচ দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। মা কালী এখানে দশভূজা। দশটি হাতে তিনি ধরে রয়েছেন গদা, তরবারি, ঢাল, শঙ্খ, খড়গ, ত্রিশুল, চক্র, ধনুক, নরমুন্ড ও খঞ্জর। রণ সাজে সজ্জিতা কালীমাতা এখানে নীলবর্ণা, গলায় ঝুলছে আসল নর করোটির মালা। বিরাট জিভ বার করে মা কালাটেশ্বরী দাঁড়িয়ে আছেন মহাদেবের বুকে। পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুরা কালাট কালীমাতার দর্শনে আসেন নিয়মিত। ভোগ দেন, ষোড়শ উপচারে পূজা করেন। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় চলে ভীষণ জাগ্রতা এই দেবীর নিত্যপূজা। এছাড়াও কালাটেশ্বরী কালী মন্দিরে, কালীপূজা, দশহরা, হোলি, গুরুপূর্ণিমা, প্রভৃতি উৎসব জাঁকজমক সহকারে পালন করা হয়ে থাকে। মন্দিরের সমস্ত অনুষ্ঠানে যথাসম্ভব সাহায্য করেন স্থানীয় বালোচ আদিবাসীরা মুসলিমরা। এমনকি মন্দিরের  দেখভালও করেন তাঁরা।

 কালাটেশ্বরী কালী মাতা

কালীমাতার বিগ্রহটির সামনে আজও রাখা আছে, শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকদেবের ছবি। বালোচিস্তানে বসবাসরত শিখদের কাছেও অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ এই কালাটেশ্বরী মন্দির। স্থানীয় লোকগাথা থেকে জানা যায় গুরু নানক সহ, অনান্য শিখ গুরুরাও বিভিন্ন সময় এই মন্দিরে এসেছিলেন। বিভিন্ন সময় এই মন্দিরে পুজো দিতে এসেছেন প্রাচীন ভারতের অনেক রাজা মহারাজা। এসেছেন অনেক বিদেশি পরিব্রাজকও। কিন্তু সময় বদলায়।  শত শত বছর ধরেই বছর ধরেই বালোচিস্তানের বুকে, স্থানীয় বালোচ ও পাশতুনদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছিলেন কয়েক লক্ষ হিন্দু। কিন্তু, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর সেই সম্পর্কে আঘাত পড়েছিল। দলে দলে হিন্দুরা বালোচিস্তান ছেড়েছিলেন, অথচ বালোচিস্তানের অর্থনীতিতে হিন্দুদের অবদান কোনওদিন অস্বীকার করা যাবে না। কারণ বালোচিস্তানের অর্থনীতি গড়েই উঠেছিল স্থানীয় হিন্দুদের হাতে। ১৯৪১ সালেও কালাট নামে স্বাধীন রাজ্যটিতে প্রায় ৫৬,০০০ হিন্দু বাস করতেন। যদিও রাজ্যটি তখন ছিল ‘খান’ যুবরাজদের অধীনে।

 মন্দিরের দ্বারের ওপরের লেখাটি বলছে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল ৭৪ খ্রিস্টাব্দে।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় ‘খান’ যুবরাজেরা কালাট রাজ্যটিকে ভারতভুক্তির দাবি জানিয়ে জওহরলাল নেহেরুকে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নেহেরু নাকচ করে দিয়েছিলেন প্রস্তাবটি। কালাট রাজ্যের হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু তিনিও কালাটকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে সফল হননি।

Advertisement

অবশেষে ১৯৪৮ সালে, পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল স্বাধীন রাজ্য ‘কালাট’। স্বাধীন কালাট রাজ্যটি পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশের ভেতর ঢুকে গেলেও, মৌলবাদীদের দাপটে পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমলেও, কমেনি কালাটেশ্বরী কালী মাতার মহিমা বরং ক্রমশ তা বেড়েছে। পাকিস্তানের নেতা মন্ত্রী ও আমলারাও যেতে শুরু করেছিলেন মা কালাটেশ্বরীর মন্দিরে। না পূজা দিতে নয়, মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা জানতে, মন্দির কতৃপক্ষকে তাঁদের সুবিধা অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু আজও মাঝে মাঝেই শান্ত কালাট শহরকে অশান্ত করে তোলে মৌলবাদীরা। কালাট কালীমাতার মন্দিরটিকেও ধ্বংস করার জন্য প্ররোচনামূলক মিটিং মিছিল করে। মৌলবাদীরা স্থানীয় পাকিস্তানের জনগণকে বোঝায়, তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশ ধরে ভারত এই অঞ্চলে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনকে অক্সিজেন জুগিয়ে চলেছে। তারা সারা পাকিস্তান জুড়ে প্রচার করে, এই অঞ্চলেই আছে পাকিস্তানের পরমাণু বোমা পরীক্ষা কেন্দ্র ‘চাঘাই’। তাই পাকিস্তানের নিরাপত্তার স্বার্থে এখানে কোনও হিন্দুমন্দির থাকা উচিত না।

 কালাট কালীমাতার মন্দিরে পাকিস্তানের প্রাক্তন মন্ত্রী আনসার বার্নি।

২০১০ সালে মৌলবাদীরা অপহরণ করেছিল মন্দিরের প্রধান পুরোহিত লক্ষীচাঁদ গড়জী ও মা কালাটেশ্বরীর দুই সেবককে। কিন্তু কয়েকদিন পরে জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। যা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর ব্যপার। এখনও নিয়মিত মন্দিরটি ভাঙার হুজুগ ওঠে। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মন্দিরটি ভাঙা সম্ভব হয় না। শোনা যায়, মন্দির ভাঙতে চেষ্টা করা অনেক মানুষের নাকি অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল কয়েকদিনের মধ্যেই। এটা হয়ত নিছকই রটনা। আসলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলি জানে, এই মন্দিরটি ভাঙলে বালোচিস্তানের মুসলিমরাও পাকিস্তানকে ছেড়ে কথা বলবেন না। এমনিতেই পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার আন্দোলন, বালোচিস্তানে জোর হাওয়া পেয়েছে। বালোচরা মনে করছেন, পাকিস্তানের কবলমুক্ত হয়ে বালোচিস্তানের স্বাধীন হওয়া, কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা। অতএব, মন্দিরটিকে ঘিরে যতই ঝড় উঠুক না কেন, মা কালাটেশ্বরীকে স্থানচ্যুত করা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। কত শক, হুন, পাঠান, মোগল, ইংরেজ এল গেল। মা কালাটেশ্বরী ১৯৪৬ বছর ধরে একই জায়গায়, স্বমহিমায় বিরাজ করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।