ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),চট্টগ্রাম প্রতিনিধি,শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪, ২৯ আষাঢ় ১৪৩১ : অনেকেই উপহার দিয়ে স্ত্রীকে চমকে দেন। কিন্তু এক পুলিশ কর্মকর্তা তার স্ত্রীকে এমন উপহার দিয়েছেন, যা দেখে পুরো দেশবাসীই চমকে উঠেছে। নিজের স্ত্রীকে কিনে দিয়েছেন পাঁচটি জাহাজ। গড়ে তোলা হয়েছে জাহাজ ব্যবসার কোম্পানি, সেটাও স্ত্রীর নামে। শপিংমল, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিসহ এই দম্পতির রয়েছে অঢেল সম্পদের পাহাড়।
Advertisement
আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান। সম্প্রতি কামরুল ও তার স্ত্রী সায়মা বেগমের অবৈধ সম্পদের খোঁজে নেমে বিস্ময়কর তথ্য পেয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান কর্মকর্তারা।
এই দম্পতির নামে এখনো পর্যন্ত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ১১ কোটি চার লাখ ৩৫ হাজার ৯১৯ টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। কামরুল হাসান পুলিশের দায়িত্ব পালনের সময় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল এই সম্পদ বানিয়েছেন বলে দুদক কর্মকর্তা জানতে পেরেছেন।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে অর্জন করা কামরুল-সায়মার সম্পদ জব্দ করতে গত সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা আদালতে আবেদন করেন দুদক কর্মকর্তা। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে সম্পদ জব্দের আদেশ দেন বিচারক।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, কামরুল অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়ে স্ত্রীকে পাঁচটি জাহাজ কিনে দেন। এগুলো নৌপথে মালামাল পরিবহন করে। এসব জাহাজের মালিক সায়মা বেগম হলেও তার নেই কোনো ধরনের বৈধ আয়ের উৎস।
জাহাজগুলোর মালিকানা কোম্পানি সওদাগর নেভিগেশন। এই কোম্পানির সিংহভাগ শেয়ারের মালিক ওই পুলিশের স্ত্রী। কিন্তু আয়ের উৎস ছাড়াই সায়মা বেগমের কয়েক কোটি টাকা দামের পাঁচটি জাহাজের মালিক হওয়ার ঘটনাটি অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের কাছে ‘অবিশ্বাস্য’ মনে হয়েছে। এগুলো যে এডিসি কামরুল হাসানের অবৈধ উপার্জনের অর্থ কেনা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মোহাম্মদ কামরুল হাসান পুলিশে চাকরি নেন ১৯৮৯ সালে। উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে যোগ দেন তিনি। তার বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের মীরওয়ারিশপুরে। তবে বর্তমানে থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর পশ্চিম নাসিরাবাদ এলাকায়।
কামরুলের রয়েছে অস্বাভাবিক ক্ষমতা। পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর দীর্ঘদিন তিনি চট্টগ্রামেই থেকেছেন। চট্টগ্রামের আটটি থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন তিনি। আর ওই সময়েই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ-বিত্তের মালিক হন বলে তদন্ত কর্মকর্তার মনে করছেন।
কতো সম্পদের মালিক এডিসি কামরুল?
আদালতে দাখিল করা দুদকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংস্থাটি প্রাথমিক অনুসন্ধানে এডিসি কামরুল হাসানের ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩১ হাজার ৯১১ টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। এর মধ্যে ১২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ২১৬ টাকার স্থাবর এবং এক কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ২১৬ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি।
আর সায়মা বেগমের নামে সম্পদের খোঁজ মিলেছে দুই কোটি ৫৩ হাজার ২৪০ টাকার। এর মধ্যে স্থাবর সম্পদ এক কোটি ২৫ লাখ টাকার আর অস্থাবর আরও এক কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার টাকার।
Advertisement
পাঁচটি জাহাজের মোট দাম কতো?
সাময়া হোসেনের মালিকানাধীন পাঁচটি জাহাজের মধ্যে চারটির নাম জানা গেছে। এগুলো হলো- এমভি প্যাসিফিক রাইডার, এমভি পানামা ফরেস্ট-১, এমভি রাইসা তারাননুম ও বার্জ আল বাইয়েত। এসব জাহাজ কেনায় কাগজে-কলমে বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে মাত্র এক কোটি ৫১ লাখ ৩১ হাজার ৩৮০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই অর্থের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করছেন অনুসন্ধান সংশ্লিষ্টরা।
অভিজাত এলাকা খুলশীতে ফ্ল্যাট
চট্টগ্রামের মহানগরের অভিজাত আবাসিক এলাকা খুলশীতে ‘ফয়জুন ভিস্তা’ অ্যাপার্টমেন্টে সি-৭ ফ্ল্যাটের মালিক কারুল হাসান। এর আয়তন দুই হাজার ৫৭০ বর্গফুট। সঙ্গে রয়েছে ১৩৬ বর্গফুটের গাড়ি পার্কিং। পাহাড়ের কোট ঘেঁষে অভিজাত ও মনোরম আবাসিক এলাকা খুলশীতে আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য তিন কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু আয়কর নথিতে, কামরুল ফ্ল্যাটের মূল্য মাত্র সাত লাখ এবং পার্কিংয়ের জায়গার দাম ২৫ হাজার টাকা দেখিয়েছেন।
চট্টগ্রামে আস্ত বাড়ি
এডিসি কামরুলের আস্ত একটা বাড়িও রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরে। পশ্চিম নাসিরাবাদে সাত শতক জমির উপর চারতলা বাড়ি। নাসিরাবাদ এলাকায় এক শতক জমির দাম এখন কোটি টাকার বেশি। ভবনের মূল্যও কোটি টাকার ওপর। সেই হিসাবে, জমি ও বাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য কমপক্ষে আট কোটি টাকা হলেও কামরুল আয়কর নথিতে জমিসহ ভবনের মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
সাভার সিটি সেন্টার
চট্টগ্রামের বাইরেও সম্পদ গড়েছেন কারুল। রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে ১০৭ শতক জায়গার উপর গড়ে তোলা হয়েছে ১২ তলার ‘সাভার সিটি সেন্টার’। বিশালাকার এই শপিংমলের মালিক চারজন। তাদের একজন এডিসি কামরুল। বিনিয়োগ দেখিয়েছেন সেখানে তিনি কাগজ-কলমে সাত কোটি ৫২ লাখ টাকা।
সাভার সিটি সেন্টারের বেজমেন্টে ৯০টি, প্রথম তলায় ১৪০টি, দ্বিতীয় তলায় ১৪৬টি, তৃতীয় তলায় ৮৯টি ও চতুর্থ তলায় ১০৩টি দোকান রয়েছে। এছাড়া এই মলে রয়েছে পাঁচ হাজার বর্গফুটের ফুডকোর্ট, পঞ্চম তলায় অফিস ও ষষ্ঠতলায় ৬৭টি ফ্ল্যাট। বাজারমূল্যে এই সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকারও বেশি বলে ধারণা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
সাভার সিটি টাওয়ার
সিটি সেন্টারের একটু পাশেই আরেকটি বিশাল ভবনের মালিকানাতে রয়েছেন এডিসি কামরুল। ১০ তলা ওই ভবনটির নাম সাভার সিটি টাওয়ার। সম্পূর্ণ আবাসিক ওই ভবনের ফ্ল্যাট সংখ্যা ৫৪টি। কয়েকজনকে সঙ্গে এই আবাসিক ভবনটি গড়েছেন কামরুল।
Advertisement
আরও জমি, ফ্ল্যাট ও দোকান
চট্টগ্রাম নগরের উত্তর হালিশহর, নাসিরাবাদ, চান্দগাঁও এলাকাতেও কামরুলের আরও বহু ফ্ল্যাট, জমি ও শতাধিক দোকান রয়েছে অনুসন্ধান কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন। তারা মনে করছেন, ঘুষ-দুর্নীতির এই কুমির নিয়ে আরও অনুসন্ধান চালালে খোঁজ মিলবে বহু অবৈধ সম্পদের।