বিশুদ্ধ শহরে নিষিদ্ধ পল্লী (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১ : লালন বলেছিলেন, গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তার জাতের কী ক্ষতি হয়। দেহব্যবসা নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতাবিরোধী হলেও এটি পৃথিবীর একটি আদিমতম পেশা।

পুরুষ শুধু অর্থের বিনিময়ে নারীর সঙ্গে কামে মিলিত হয়, নারীদেহ ভোগ করে। যারা শরীরকে উপজীব্য করে অর্থ উপার্জনের তাগিদে একাধিক পুরুষের সঙ্গমার্থে দেহ বিক্রি করে, তারা সমাজে দেহোপজীবিনী, পতিতা বা বেশ্যা নামে পরিচিত হয়। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে এটি অবৈধ পেশা। এটা সমাজকে কলুষিত করে। জনস্বাস্থ্যের ওপরও হুমকিস্বরূপ। আর সে কারণেই এটি অপরাধ এবং আইনগতভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পেশাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

Advertisement

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাসে গণিকা বা পতিতাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে পতিতাবৃত্তির ইতিহাসেরও পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়েছে। কোথাও কোথাও হয়েছে বৈধ, মার্জিত, উন্নত, গ্রহণযোগ্য। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গণিকাবৃত্তির জন্মস্থান প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান গ্রিস। এবং বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে পতিতাবৃত্তির সুদৃঢ় অবস্থান লক্ষণীয়।

অ্যাডভোকেট সাহিদা বেগম তার মূল্যবান বই ‘পতিতা আইন’-এ লিখেছেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির বিশ্বে নারীও আজ মুক্তপণ্য। নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতার স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে কেনাবেচার হাটবাজারে নারী আজ পণ্য হিসেবে উচ্চমূল্যের ভোগ্যপণ্যে পরিণত হয়েছে।’ আমি বলবো, আজ নয়, সেটা শুরু হয়েছে পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে। প্রতিটি ধর্মে পুরুষ কীভাবে নারীকে ব্যবহার করবে তার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কখনো কখনো ধর্মই নারীর অপব্যবহারের একটি অন্যতম উৎস। সনাতন ধর্মে সেবাদাসীর কথা জানতে পারা যায়। এসব সেবাদাসী শরীর আর যৌবন দিয়ে সেবা করে যায় মন্দিরের পুরোহিতের। এটাও এক ধরনের বেশ্যাবৃত্তি। যার বিনিময়ে সেবাদাসীরা পায় আহার আর আশ্রয়। দক্ষিণ ভারতের পতিতাদের মধ্যে আশি শতাংশই হচ্ছে মন্দির থেকে আসা সেবাদাসী। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বা পুরাণে আছে, দশরথ তার সেনাদলে গণিকাদের নিযুক্ত করেছিলেন।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, মহাভারতে উল্লেখ আছে, একজন বেশ্যা ভালো প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। মহাভারতের যুগে অন্যান্য পেশার মধ্যে পতিতাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। অনেক খারাপ কাজের মতো আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে আরবে পতিতাবৃত্তিও ছিল। দীর্ঘস্থায়ী মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে সম্রাট আকবরের ২৮ জন উপপত্নী ছিল। সে সময় মুঘল দরবারে নাচ-গানের জলসায় বাইজি এবং নটীদের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। এরা ছিল দরবারের আমির-ওমরাহদের রক্ষিতা। মোগল রাজত্বই গণিকাদের স্বর্ণযুগ ছিল।

Advertisement

ঋগ্বেদ-এ উল্লিখিত ‘বিশ্য’ শব্দ থেকে বেশ্যা শব্দটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে। যেমন- দেহোপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, পুংশ্চলী, অতীহরী, বিজর্জরা, গণিকা, বারাঙ্গনা ইত্যাদি। বর্তমান সমাজে আমরা শুদ্ধ করে এদের যৌনকর্মীও বলে থাকি। তবে সমাজের উঁচুস্তরের কল গার্লদের চেনাটাই মুশকিল। তারাও যে সমাজ থেকে পতিত নারী, পতিতা, সেটা তারা মানতে রাজি নয়। আঙ্গুল ওঠে কেবল নিষিদ্ধ পল্লীর পতিতাদের বেলায়। শাব্দিক অর্থে পতিতা, গণিকা, কল গার্ল কিংবা পর্নো তারকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু অবস্থানের।

কেবল সমাজে নৈতিকতা, আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে নর্দমার কীটের মতো বেঁচে থাকে নিষিদ্ধ পল্লীর পতিতারা। ভাগ্যবিড়ম্বিত, অসহায়, নিরক্ষর, অভাবগ্রস্ত এসব নারীরা শুধু অবহেলিতই হয়ে থাকে। আর কিছু বিকৃতরুচির পুরুষ তাদের দৈহিক চাহিদা মেটানোর পর এসব নারীদেরই নষ্টনারীর উপাধি দিয়ে নিজেরা ভদ্রতার পোশাক পরে পরিবারে, সমাজে বেশ ভালো থাকে। আমাদের দেশে পতিতাবৃত্তিকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে পতিতাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আবার সমাজ থেকে এই বৃত্তি বা পেশাকে নির্মূল করে দেওয়ার আগ্রহও রাষ্ট্রের প্রকাশ পায় না।

পতিতাদের নিয়ে নাটক, সিনেমা, সাহিত্যও সৃষ্টি হয়েছে অনেক। এসবের সৃষ্টিকর্তারও বাদ পরেন না পতিতাদের সাহচর্য থেকে। সভ্যতা এগিয়ে গেছে, বদলেছে অনেক কিছু। শুধু বদলায়নি এসব নারীদের ভাগ্য। তাই, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে সুবিধাবঞ্চিত, অন্ধকারবাসিনী এসব নারীদের শুধু একটা মাংসপি- না ভেবে নষ্ট নারী হিসেবে না দেখে সব মানবীয় গুণসম্পন্ন এবং একটি স্বাভাবিক মনের অধিকারী, সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে দেখে এদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

Advertisement

আপনাদের বিশুদ্ধ শহরের এই নিষিদ্ধ পল্লীবাসীরা একটু হলেও ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক আমাদের সমাজ। নির্মলেন্দু গুণের আমার একটি প্রিয় কবিতা, ‘অসমাপ্ত কবিতা’র দুটি লাইন-‘আপনারা কেউ বেশ্যাপাড়ায় ভুলেও যাবেন না—/এরকম প্রতিশ্রুতি দিলে বেশ্যার দালাল হতে পারি/রসোন্মত্ত যৌবন অবধি, একা-একা।

খাদিজা আক্তার : শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী।