ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),রাজশাহী প্রতিনিধি,সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১ : রাজশাহীতে উপ-কর কমিশনারের অফিস ড্রয়ার থেকে দুদক কর্মকর্তারা যেভাবে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা বের করেছেন সেটি দেখে অনেকই হতবাক। দুদকের আকস্মিক অভিযানে কর কর্মকর্তার ড্রয়ার থেকে ১০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ হচ্ছে, এসবই ঘুষের টাকা। এরপর শরীয়তপুরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের কার্যালয়ে একই ধরনের আরেকটি অভিযান চালায় দুদক। একজন ব্যবসায়ীর অভিযোগের সূত্র ধরে বিসিক কর্মকর্তাকে ৫০ হাজার টাকা ‘ঘুষসহ’ হাতেনাতে ধরে দুদক।
Advertisement
দুদক বলেছে, তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এসব অভিযান পরিচালনা করে না। বরং সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই এ ধরনের অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই অভিযান কতগুলো হবে, সেগুলো নির্ভর করে অভিযোগ পাওয়ার উপর। দুদক যে সব দপ্তরে অভিযান চালায়, তার মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ রেলওয়ে। এছাড়া আরো বিভিন্ন সরকারি দপ্তরেও অভিযান চালানো হয়। দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের হটলাইনে যদি ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন তাহলে সেটি দুদকের তফসিলভুক্ত হলে তার অভিযোগটি যাচাই করা হয়। তিনি বলেন, ২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযান চালানো শুরু করে দুদক। দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ত্রৈমাসিকের তথ্য অনুযায়ী, সে বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসে ৪৯১টি অভিযোগের বিষয়ে কাজ শুরু করে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৭৪টি অভিযান চালায় দুদক। অভিযানের পর কমিশনের অনুমোদনে অনুসন্ধান হয় ১১টি অভিযোগের।
দুদক সচিব বলেন, ‘যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তিনি যদি ‘স্বভাবজাত অপরাধী’ হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়। এ সময় যদি দেখা যায় যে, অভিযোগের সত্যতা রয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি সেটি করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ‘ফাঁদ মামলা’ করা হয়।’ ফাঁদ মামলা হচ্ছে, যিনি ভুক্তভোগী তার কাছে যে ঘুষ অভিযুক্ত ব্যক্তি দাবি করেন তাকে তিনি সেটি দেন বা দিতে থাকেন। তখন দুদকের একটি দল তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারের পর ওই ব্যক্তিকে আদালতে সোপর্দ করা হয় এবং পরবর্তীতে আদালতের নিয়মানুযায়ী তার বিচারকাজ পরিচালিত হতে থাকে। তবে মামলা দুদকের পক্ষ থেকে দায়ের করা হয়। শুরুর দিকে দুদক বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও মাঝে কিছু সময় অভিযানের পরিমাণ বেশ কমে এসেছে বলে জানায় দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংখ্যা দিয়ে হয়তো পরিমাপ করা যাবে না, তবে এক সময় দুদকের অভিযানগুলো বেশ ভালোই পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু পরে সেগুলো কমে গেছে এবং এখন মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
অভিযানগুলো কেন নিয়মিত হয় না এমন প্রশ্নের উত্তরে দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, দুদক আসলে স্বপ্রণোদিত হয়ে অভিযান চালায় না। বরং কেউ দুদকের হটলাইনে অভিযোগ করলে সেই অভিযোগ প্রাথমিকভাবে যাচাইয়ের পর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে অভিযোগের সত্যতা পেলে অভিযান চালানো হয়। এর জন্য প্রথমে অভিযোগ জানানোটা জরুরি বলে জানান তিনি। ‘বিষয়টা আসলে কেউ তো আমাদের অভিযোগ করতে হবে। একজনকে তো জোর করে ধরা যাবে না। এজন্য কখনো কম হয়, কখনো বেশি হয়, এইরকম বিষয়টা,’ বলেন দুদক সচিব।
টিআইবি বলেছে যে, দুদকের এ ধরনের অভিযান কমে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। তারমধ্যে একটি হচ্ছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি যে ব্যাপকতর ও গভীরতর হচ্ছে তার তুলনায় দুদকের সক্ষমতায় ঘাটতি থাকতে পারে।
Advertisement
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক দুদক ক্রমাগতভাবে ‘আমলাতন্ত্র নির্ভর’ হয়ে পড়ার কারণেও প্রতিষ্ঠানটির সক্রিয়তা অনেকাংশে কমে গেছে। একারণে অনেক সময় সিলেক্টিভ ওয়েতে যাদের সঙ্গে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশ নেই বা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নাই, এ ধরনের ক্ষেত্রে তারা(দুদক) অগ্রসর হয়। দুদক অবশ্য সবসময় দাবি করে যে, তাদের উপর কোনো চাপ নেই এবং তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে।
দুদকের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল এবং দেশের মানুষের কাছে এর একটি চাহিদা তৈরি হয়েছিল। টিআইবি-ও এ ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখার পক্ষে ছিল। ‘সাম্প্রতিক কালে দুটো ঘটনামাত্র ঘটেছে। আমরা আশা করবো যে এ ধরনের অভিযান আরো বেশি অব্যাহত থাকুক, দুদকের সেই এখতিয়ার আছে এবং সুযোগও আছে,’ বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
দুদক এ পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে তার সিংহভাগই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। এ ধরনের অভিযোগ দুর্নীতি দমনে কতটা প্রভাব ফেলবে এমন প্রশ্নে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, এই ধরনের অভিযান আগেও হয়েছে। তাই এর প্রভাব কতটা হবে সেটা বলা মুশকিল। তবে এ ধরনের অভিযানের একটা ‘ডেমনেস্ট্রেশন ইফেক্ট’ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি। অর্থাৎ যদি কোনো সরকারি অফিসে অভিযান চালানো হয়, তাহলে ওই দপ্তরের অন্য কর্মকর্তারাও সাবধান হয়ে যাবে। এছাড়া অন্য কোনো দপ্তরের কর্মকর্তারাও হয়তো মনে করবে যে, তাদের দপ্তরেও অভিযান চলতে পারে।
আবু আলম শহীদ খান বলেন, দুদকের মূল কাজ আসলে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা না। তাদের মূল কাজ হচ্ছে, যেসব মামলা তাদের কাছে আছে এবং বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে সেগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা। তার পাশাপাশি এই অভিযানগুলো চলবে। তাহলে হয়তো দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজে সফলতা আসবে বলে মনে করেন সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা।
Advertisement
সফলতার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, কাউকে যখন হাতেনাতে ধরা হয়, তখন তো এটা প্রতীয়মান হয় যে তিনি ঘুষ নেয়ার উদ্দেশ্যেই অর্থটা নিয়েছেন। এটা সফলতা নয় উল্লেখ করে মি. হোসেন বলেন, আদালতে বিচারের মাধ্যমে অপরাধীর শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে সেটি শতভাগ সফলতা বলে ধরা যায়। ‘কিন্তু যদি খালাস হয় তাহলে মনে করতে হবে যে, কোথায় আমাদের বিচ্যুতি থাকতে পারে তদন্তে, আমাদের রেকর্ডপত্র উপস্থাপনে,’ বলেন দুদক সচিব।