আত্মগোপনে মতিউরের স্ত্রী লাকী, গড়েছেন সম্পদের পাহাড়

SHARE

স্বামী মতিউর রহমানের সঙ্গে লায়লা কানিজ লাকী

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),নরসিংদীর রায়পুরা প্রতিনিধি ,সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪, ১০ আষাঢ় ১৪৩১ : ছেলে মুশফিকুর রহমানের (ইফাত) ১৫ লাখ টাকার ছাগলকাণ্ডের ঘটনায় অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারসহ নানান বিষয়ে ভালোই বেকায়দায় পড়েছেন বাবা মতিউর রহমান। রবিবার (২৩ জুন) তাকে এনবিআর থেকে সরানোর পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক থেকেও অপসারণ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসবের জেরে এখন আলোচনায় মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরার উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী। জেলাজুড়ে মানুষের মুখে মুখে এই উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্পদের আলোচনা।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৫ লাখ টাকায় আলোচিত সেই ছাগল কিনতে যাওয়া মুশফিকুর রহমান এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় ঘরের সন্তান।

Advertisement

এদিকে গত কয়েকদিন ধরে লায়লা আত্মগোপনে আছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে রবিবার দুপুরে এই প্রতিবেদক কয়েকবার কল দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার নম্বরে রাতে আবার কল দিয়ে নম্বর খোলা পেলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার দুই ঘনিষ্ঠজনকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, আপার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কোথায় আছেন তাও বলতে পারেননি। কিন্তু তিনি কেন আত্মগোপনে, তার সমস্যা কোথায়- এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে।

 

জানা গেছে, লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’ নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানেই ২০১৮ সালে পরিচয় হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য (নরসিংদী-৫) রাজিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। এরপর থেকে ওই পার্কে অবকাশযাপন করতে যেতেন। একপর্যায়ে লায়লাকে রাজনীতিতে আমন্ত্রণ জানান এমপি। ২০২৩ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান মারা গেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন ও সংসদ সদস্যের প্রভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক।

 

উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, শুধুমাত্র অবৈধ টাকার জোরেই লায়লা স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদের পৃষ্ঠপোষকতায় রায়পুরার রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন। রাজনীতিতে খরচ করা সবই তার স্বামী আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ‘অবৈধ উপার্জনের টাকা’। শিক্ষকতার আয়ে তার এত সম্পদ থাকার কথা নয়। তাকে জোর করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতারা এখন কোণঠাসা। অবস্থা এখন এমন এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান এক পক্ষ এবং সব আওয়ামী লীগ নেতা অন্য পক্ষ। এমপির সহযোগিতায় নরসিংদীর সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়নও চেয়েছিলেন তিনি।

 

লায়লা কানিজ লাকীর বাড়ি

লায়লা কানিজ লাকীর বাড়ি

 

শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লা কানিজের নামে প্রচুর সম্পদ। তার নির্বাচনি হলফনামা থেকে জানা গেছে, তার বাৎসরিক আয় কৃষিখাত থেকে ১৮ লাখ, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, শেয়ার সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে এক লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তার কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ, তার অকৃষিজমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ।

 

কিন্তু লায়লার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বলছে, তিনি তার মোট সম্পত্তির মাত্র অর্ধেকেরও কম দেখিয়েছেন হলফনামায়।

 

মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়িটি বেশ বিলাসবহুল। বাড়িজুড়ে দেশি-বিদেশি গাছের সারি, সবুজ ঘাসের আঙিনা। পেছনে রয়েছে ঘাট ও লেক। পাশে রয়েছে কর্মচারীদের থাকার জায়গা।

 

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছেন এমন কয়েকজন জানান, বাড়িটিতে মতিউর রহমান মাঝেমধ্যে এলেও প্রায় সবসময়ই লায়লা কানিজ থাকেন। এর ভেতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামি জিনিসপত্রে ঠাসা।

 

ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দেড় একর আয়তনজুড়ে পার্কটির অবস্থান। ভেতরে রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। বিভিন্ন বয়সীদের জন্য রয়েছে বেশকিছু রাইড। পুরো পার্কজুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই পার্কে ঘুরতে আসেন। এটি স্থানীয়দের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজের পার্ক হিসেবে প্রচারণা আছে। তবে ছাগলকাণ্ডের পর পার্কের লোকজন এটি চেয়ারম্যানের পার্ক নয় বলে জানাচ্ছেন। তবে লায়লার দুই সন্তান যে এর পরিচালক, তা নিশ্চিত করেছেন তারা।

 

পার্কটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দেওয়া আবুল খায়ের মানিক জানান, লায়লা কানিজ শুধু পার্কের ভেতরের পুকুরের মালিক। তবে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মতিউর-লায়লা দম্পতির দুই সন্তান।

 

এদিকে নরসিংদী শহরের নাগরিয়াকান্দিতে গোল্ডেন স্টার পার্ক নামের নির্মাণাধীন একটি বিনোদনকেন্দ্রে লায়লা কানিজ পার্টনার হিসেবে রয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। রবিবার দুপুরে পার্কটিতে গিয়ে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদল সরকারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

Advertisement

তিনি দাবি করেন, ‘এ পার্কের সঙ্গে লায়লা ও তার স্বামী মতিউর রহমানের কোনও মালিকানার সম্পর্ক নেই। ছাগলকাণ্ডে তাদের নাম চলে আসায় টিভি-পত্রিকায় তাদের দেখেছি, কিন্তু কোনোদিন তাদের নিজের চোখে দেখিওনি।’

 

লায়লা কানিজের ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’

লায়লা কানিজের ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’

 

স্থানীয়রা বলছেন, তার বাবা কফিল উদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন খাদ্য কর্মকর্তা। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে লায়লা সবার বড়। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে তার উত্থান দেখেছেন স্থানীয়রা। পৈতৃক বাড়িতে রাজপ্রাসাদতুল্য একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। ছোট পার্কটিকে ক্রমে আধুনিক করে ইকো রিসোর্ট তৈরি করেছেন। এলাকায় প্রচুর দান-খয়রাতও করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে তিনি রায়পুরার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে উঠেছেন।

 

মরজাল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাজিদা সুলতানা নাসিমা দাবি করেন, ‘লায়লা কানিজ অর্থ দিয়ে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাচ্ছেন। মানুষকে হয়রানি করছেন। আর এমপি রাজিউদ্দীন সাহেবের মতো লোক তাদের ভক্ত হয়ে গেছে।’

 

রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসাইন দাবি করেন, ‘দুঃখের কথা কী বলবো? এমপির উৎসাহেই রাজনীতিতে এসেছেন লায়লা কানিজ। তিনি একটা টাকার পাহাড়। স্বামীর অবৈধ টাকার প্রভাবেই এমপি সাহেব তাকে গুরুত্ব দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। তিনি প্রভাব খাটিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে কেউ যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন। দলে কি আর কোনও নেতা ছিল না?’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘গত ৫৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। আমাকে পর্যন্ত প্রার্থী হতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, আপনার তো টাকা নাই, নির্বাচন কীভাবে করবেন? শুধু সমর্থন চেয়েছিলাম, তাও পাইনি। লায়লা কানিজকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের খুব বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদ। এর জন্য ভবিষ্যতে আমাদের মূল্য দিতে হবে। টাকাই কি সব? আর এসব টাকা তো তার নিজের নয়, স্বামী মতিউর রহমানের।’

 

রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও এমপি রাজিউদ্দিনের ছেলে রাজিব আহমেদ বলেন, ‘লায়লা কানিজ লাকি রাজনীতি করেই উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছে জনগণের ভোটে। এই চলমান ইস্যু নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না আমি।’ এই বলে তিনি মোবাইল ফোনের সংযোগ কেটে দেন।