শিমুল ভূঁইয়া ও কসাই জিহাদ (ডানে)
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),ঝিনাইদহ প্রতিনিধি ,রোববার, ২৬ মে ২০২৪, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ : আলোচিত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে শিমুল ভূঁইয়া ও তার ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া গ্রেপ্তারের পর তাদের খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের বাড়ি ‘ভূঁইয়া ম্যানশন’ থেকে পরিবারের সবাই আত্মগোপন করেছেন। গত তিন দিন ধরে তাদের ওই বাড়ি তালাবদ্ধ। বিরাজ করছে নিরবতা। মাহমুদ হাসান ভূঁইয়া ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও তার পরিবার সম্পর্কে ভয়ে মুখ খুলছেন না এলাকাবাসী।
Advertisement
ভারতে চিকিৎসা করাতে যাওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের মাননীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকারীদের বিচার চাই ।
কুমিল্লা মেঘনা উপজেলার চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম তাজ
প্রসঙ্গত, গত ১৩ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামি ৮ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। আসামিরা হলেন- আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া এবং শিলাস্তি। গত ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলানগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন নিহত আনোয়ারুল আজিম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
দামোদর গ্রামের বাসিন্দাদের ধারণা, ভূঁইয়া পরিবারের হাত অনেক লম্বা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে, কিছু দিন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে তোলপাড় হলেও শিমুল ভূঁইয়ার কিছুই হবে না। এ কারণে তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিয়ে কেউ বিপদে পড়তে চাচ্ছেন না।
এলাকাবাসী জানায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) সামরিক শাখার প্রধান মাহমুদ হাসান ভূঁইয়া ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ ওরফে আমানুল্লাহ সাঈদ ওরফে শিহাব ওরফে আবুল ফজল ওরফে ফজল মোল্লা ওরফে ফজল গ্রেপ্তারের আগে আত্মগোপনে থাকলেও মাঝে-মধ্যে রাতের আধারে ছদ্মবেশে দামোদরে গ্রামের বাড়িতে আসতেন। বয়স্ক দুই-একজন ব্যক্তি ছাড়া এলাকার অন্য কেউ তাকে চিনতেন না।
Advertisement
ফুলতলা বাজারসহ আশপাশ এলাকার দোকানগুলোতে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত শিমুল ভূঁইয়ার ছবি দেখার জন্য কৌতূহলী মানুষরা ভিড় করেন। পত্রিকায় শিমুল ভূঁইয়ার ছবি দেখে একজন মৃদু কণ্ঠে বলেন, এমন সুন্দর চেহারার মানুষ-ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ও নিষ্ঠুর হতে পারেন ভাবতে পারছি না’। তিনি বলেন, এলাকার মানুষ শিমুল ভূঁইয়ার নাম শুনলেও তাকে সরাসরি কখনো দেখেননি। তার ছবিও দেখা যায় না। তার সন্ত্রাসী জীবনের কাহিনী সবাই জানে। ফলে তার প্রতি স্থানীয় মানুষের কৌতূহল রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিমুল ভূঁইয়া ফুলতলা উপজেলার দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। ক্লাস এইট পর্যন্ত তার রোল নম্বর এক (১) ছিল। এরপরই তিনি অপরাধ জগতে জড়িয়ে যান।
এ ব্যাপারে শিমুল ভূঁইয়ার এক স্কুল বন্ধুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে, দামোদর গ্রামের আরেক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিমুল ভূঁইয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স পাস করার কথা বলা হলেও এটি ঠিক নয়। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, খুব কম বয়সে তিনি অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন। একাধিক হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। দীর্ঘদিন পর কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে তিনি এতোদিন পলাতক ছিলেন। ফলে তার লেখাপড়াও খুব বেশি হওয়ার কথা নয়।
Advertisement
এদিকে শিমুল ভূঁইয়ার মতো তার ভাই-ভাতিজাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী ও পুলিশ। তাদের মতে গোটা পরিবারই সন্ত্রাসী।
এলাকাবাসী জানান, শিমুল ভূঁইয়ার সেজো ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে মুকুল ভূঁইয়া বোমা তৈরি করতে গিয়ে তার ডান হাত হারান। এরপর তার নাম হয় ‘হাত কাটা মুকুল’। তিনিও চরমপন্থি দল জনযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। একাধিক মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। ২০০৪ সালের তিনি ক্রসফায়ারে নিহত হন।
শিমুলের ছোট ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে শিপলু ভূঁইয়া। তিনি দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। ফুলতলা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও খুলনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন মিঠু হত্যা মামলাসহ তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা ছিল। বর্তমানে একটি মামলাও তার বিরুদ্ধে নেই। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার তানভীর ভূঁইয়া শিমুল ভূঁইয়ার বড় ভাই হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে লাকি ভূঁইয়ার ছেলে। তানভীর ভূঁইয়া তিন বছর আগে অস্ত্র ও মাদকসহ দামোদরের ভৈরব নদীর পাশ থেকে গ্রেপ্তার হন।
ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শিপলু ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা ছিল তা আদালত থেকে খারিজ হয়ে গেছে। এছাড়া গত ১০ বছরে তার নামে একটি মামলাও হয়নি। তবে, তার ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া তিন বছর আগে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
শিমুল ভূঁইয়াদের দামোদরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। ঘরের দরজা-জানালাও বন্ধ। স্থানীয়রা জানান, ঢাকায় শিমুল ভূঁইয়া গ্রেপ্তারের পর থেকেই তার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান শিপলু ভূঁইয়াসহ বাড়ির সবাই আত্মগোপন করেছেন।
Advertisement
৫ বছর আগে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে সম্পর্ক হয় আজিজের: সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার ফুলতলা উপজেলার আলকা গ্রামের আজিজ ওরফে আজির (৩৫) সঙ্গে পাঁচ বছর আগে চরমপন্থি দলের নেতা শিমুল ভূঁইয়ার যোগাযোগ হয়। ফুলতলা বাজারের দরিদ্র ডাব বিক্রেতা আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে আজিজ। ১০ বছর আগে আজিজ ফুলতলা বাজারসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে ভ্যান চালাতেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একবার আলকা গ্রামে চুরি করে ধরা পড়েন আজিজ। এরপর তিনি ট্রাকের হেলপার হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরে ট্রাক ড্রাইভার হন। তিন বছর আগে আজিজ ফুলতলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পাশাপাশি তিনি চরমপন্থি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে আজিজের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর প্রচার হওয়ার পর ফুলতলা এলাকার মানুষ অবাক হন।
ভারতে গ্রেপ্তার কসাই জিয়াদের বাড়ি দিঘলিয়ায়: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের লাশ টুকরো টুকরো করার অভিযোগে ভারতের মুম্বাইয়ে গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদার (২৪) ওরফে কসাই জিহাদের বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে। ফুলতলা ও দিঘলিয়া পাশাপাশি উপজেলা। মাঝখানে ভৈরব নদী। শিমুল ভূঁইয়ার বাড়ি থেকে সামান্য দূরে বারাকপুর গ্রামের গাজীপাড়ার রং মিস্ত্রি জয়নাল হাওলাদারের ছেলে জিহাদ।
ভারতের মিডিয়ায় জিহাদ হাওলাদারকে কসাই হিসাবে বর্ণনা করা হলেও স্থানীয়ভাবে তাকে কেউ ‘কসাই’ হিসাবে কাজ করতে দেখেননি। তবে প্রায়ই ভারতে যাতায়াত করতেন তিনি। ভারতের মুম্বাই এবং খুলনার বারাকপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় দিঘলিয়া উপজেলার অনেক মানুষ কাজ করেন। এজন্য তার ওইসব এলাকায় যাতায়াত ছিল। একজন সংসদ সদস্য খুনের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন জিহাদ তা এলাকার কেউ ভাবতে পারছে না। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ।
বারাকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গাজী সাহাগীর হোসেন পাভেল বলেন, জিহাদ হাওলাদারকে গত দেড়-দুই বছর এলাকায় দেখা যায়নি। আমাদের এলাকায় তার বিরুদ্ধে অপরাধ করারও কোনো অভিযোগ নেই। তার পরিবার ভালো। তার বাবা রঙ মিস্ত্রির কাজ করতেন। বড় ভাই-ভাবি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আরেক ভাইও মাদরাসার শিক্ষক।
Advertisement
জিহাদের বাবা জয়নাল হাওলাদার বলেন, আমার প্রত্যেকটি ছেলে প্রতিষ্ঠিত। কুলঙ্গার এই ছেলের দায়ভার আমার পরিবার নেবে না।
দিঘলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আকতার বলেন, ভারতে জিহাদ হাওলাদারের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছ থেকে অনেক ফোন পাচ্ছি। আমাদের কাছে তার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশনা দেননি। তারপরও আমরা জিহাদ হাওলাদারের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।