ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),রাজশাহী প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪ : রাজশাহীতে আবাসন ব্যবসার নামে প্রতারণায় মেতে উঠেছিলেন এক ব্যক্তি। সাধারণ মানুষ তো বটেই, উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাও তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছিলেন। প্রতারণার এক মামলায় অবশেষে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতের নাম মোস্তাফিজুর রহমান (৩০)।
রাজশাহীতে তিনি মুস্তাফিজ নামে পরিচিত। পাঁচ বছর আগের বেকার এই যুবক এখন অন্তত ২০ কোটি টাকার মালিক। চড়েন দামি হ্যারিয়ার গাড়িতে। তার প্রতারণার কথা মানুষের মুখে মুখে।
Advertisement
মুস্তাফিজের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে। বাবার নাম আব্দুর রাকিব। দরিদ্র পরিবারের সন্তান মুস্তাফিজ ২০১০ সালে এসএসসি পাস করার পর রাজশাহী চলে আসেন। এরপর ভর্তি হন পলিটেকনিকে। পড়াশোনার খরচ চালাতে নগরীর রাজারহাতা এলাকার প্রয়াত ব্যাংক কর্মকর্তা মাইনুল হাসানের দত্তক ছেলে হিসেবে তার বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিছুদিন পর মাইনুল হাসান মারা যান। তার স্ত্রী নাসরিন সুলতানা মুস্তাফিজকে ছেলের মতোই দেখে রাখেন।
পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা করার পর মুস্তাফিজ ফুসলিয়ে নাসরিনের গচ্ছিত টাকা হাতিয়ে নেন। বাড়ির জমিটিও হাতিয়ে নেন ডেভলপার হিসেবে ভবন নির্মাণের কথা বলে। তারপর থেকেই মুস্তাফিজের উত্থান শুরু। এ ঘটনায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন নাসরিন। তার জমি নেই, টাকা নেই। শেষ বয়সে তাকেই এখন ভাড়া থাকতে হয় অন্যের বাড়িতে।
মুস্তাফিজ শহরের অন্তত অর্ধশত ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে এজাজুল হক নামের এক প্রতারিত ব্যক্তি গতকাল সোমবার রাতে বোয়ালিয়া থানায় মামলা করেন। এই মামলায় রাতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) সকালে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেভলপার ব্যবসায়ী হিসেবে এখন পর্যন্ত মোট ৬টি জায়গা নিয়েছেন মুস্তাফিজ। এর মধ্যে দুটি জায়গায় কাজ শুরু করেছেন। বাকিগুলোতে কাজ শুরু করতে না পারলেও সেখানেও ফ্ল্যাট বিক্রির কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জমির মালিকদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি কাউকেই ঠিকমতো ভাড়া দেননি। আবার কাউকে কাউকে একেবারেই দেননি। এ নিয়েও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এ জন্য আবু হানিফ নামের এক জমির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করে তাকেই জেল খাটিয়েছেন। সম্প্রতি আবু হানিফ সংবাদ সম্মেলন করে মুস্তাফিজের শাস্তি দাবি করেন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ডা. মহিবুল হাসান বলেন, ‘আমার একটি জমি মুস্তাফিজকে দিয়েছিলাম। কিন্তু, সে কোনো শর্তই মানেনি। এর পর আমি চুক্তি বাতিল করেছি। তাই ১০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। সে একজন প্রতারক। প্রতারণাই তার মূল কাজ।’
নগরীর রেশমপট্টি এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক ফ্ল্যাট কিনতে মুস্তাফিজকে দিয়েছিলেন ২৭ লাখ টাকা। কিন্তু, শর্ত না মানার কারণে তিনি পরে ফ্ল্যাট নিতে চাননি। টাকা ফেরত চাইলে দেড় বছর ঘুরিয়েছেন মুস্তাফিজ। ওমর ফারুক জানান, নানা দেন-দরবার আর সালিশের পর তিনি ২৪ লাখ টাকা পেয়েছেন। মুস্তাফিজের কাছে এখনো ৩ লাখ টাকা পাবেন তিনি।
Advertisement
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল ইসলামের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন মুস্তাফিজ। কামরুল এ নিয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। মেয়র বিষয়টি সমাধানের জন্য মুস্তাফিজকে নির্দেশ দিলেও তিনি কানে তোলেননি। পরে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) হেদায়েতুল ইসলামের কাছে অভিযোগ করেন কামরুল ইসলাম। পুলিশের এই কর্মকর্তা মুস্তাফিজকে ডাকলেও তিনি যাননি।
কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ফ্ল্যাট দিতে মুস্তাফিজ আমার কাছ থেকে প্রথম দফায় ২৫ লাখ টাকা নেন। কিন্তু, ওই ফ্ল্যাট তিনি রাজশাহী কলেজের এক শিক্ষকের কাছে বিক্রি করেন। বিষয়টি জানতে পেরে আমি টাকা ফেরত চাই। মুস্তাফিজ আমাকে ঘোরাতে থাকেন। পুলিশে অভিযোগ করার পর, তিনি আমাকে অন্য আরেকটি ফ্ল্যাট দিতে চান। এ জন্য আরও ১০ লাখ টাকার মতো নেন। ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার দিন করেও দেয়নি।’
সাদিকা খাতুন নামের এক নারী বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু, আমি ফ্ল্যাট পাইনি। টাকার জন্য ঘুরছি। রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি।’
গোদাগাড়ীর বাসিন্দা এজাজুল হকের মামলায় পুলিশ মুস্তাফিজকে গ্রেপ্তার করেছে। এজাজুল বলেন, ‘ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য মুস্তাফিজ আমার কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নেয়। কিন্তু ফ্ল্যাট দেয়নি। টাকা চাইলে তিনি তার অফিসে ডেকে নিয়ে আমার কাছ থেকে চুক্তিপত্রের কাগজপত্র কেড়ে নিয়েছেন। আমি ফ্ল্যাট পাইনি, টাকাও ফেরত পাইনি। তাই মামলা করেছি।’
দড়িখরবোনা এলাকার বাসিন্দা আবু হানিফের স্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে একটি জমি হাতিয়ে নেন মুস্তাফিজ। বাড়ি ভেঙে সব মালামাল নিয়ে গেলেও মুস্তাফিজ কাজ শুরু করতে পারেননি। তাই পরিবারটিকে অন্য বাড়িতে ভাড়া থাকতে হচ্ছে। হানিফ বলেন, ‘মুস্তাফিজ কাজ শুরু করতে পারেনি। তাই আমি অন্য ডেভলপারের সঙ্গে চুক্তি করি। এ জন্য মুস্তাফিজ আমার নামে মিথ্যা মামলা করে জেল খাটিয়েছে। কিছুদিন আগে আমি জামিনে মুক্তি পেয়েছি।’
গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেটর চেয়ারম্যান হিসেবে কাগজে-কলমে রাখা হয়েছে মুস্তাফিজের দত্তক বাবা মাইনুল হাসানের শ্যালক ওয়ালিউর রহমান বাবুকে। বাবু বলেন, ‘আমার বোনের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন মুস্তাফিজ। সে টাকার কোনো হিসেব নাই। আমাদের একটা জমিও ডেভলপার হিসেবে নিয়েছেন তিন বছর আগে। কাজ শুরু করতে পারেননি। আমরা এখন ভাড়া থাকি। আমাকে চেয়ারম্যান করে রাখা হলেও, আমি কোনো খোঁজ রাখি না। মুস্তাফিজের কারণে আমার বোন এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
মুস্তাফিজ বিজ্ঞাপন প্রচার করে ফ্ল্যাট বিক্রি করলেও রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) নিবন্ধিত নয় গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট। শুধু আরএডিএ থেকে প্ল্যান পাস করিয়ে তিনি ভবন নির্মাণ করতেন। তারপর প্ল্যান না মেনে ইচ্ছামতো ফ্ল্যাটের আকার বাড়িয়ে নির্মাণ করতেন। বিষয়টি জানতে পেরে গত বৃহস্পতিবার মুস্তাফিজকে কারণ দর্শানোর দুটি নোটিশ দিয়েছে আরডিএ।
আরডিএর অথোরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গ্রীণ প্যালেস ও গ্রীণ মনোয়ারা প্যালেস নামক দুটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার বাইরে অতিরিক্ত অংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলব। তার আগে কারণ দর্শানোর একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, আরডিএর তালিকাভুক্ত আবাসন ব্যবসায়ী না হয়েই বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্ল্যাট ব্যবসা শুরু করেছিলেন মুস্তাফিজ। সে জন্য আরেকটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘মুস্তাফিজ একসময় চেম্বারের পরিচালক পদও বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তখন আমাদের কাছে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার তিনটি অভিযোগ আসে। একটির মীমাংসা করেছি। দুটি পারিনি। উনার অফিস চেম্বার ভবনেই। তিনি ভাড়া নিয়েছেন। গত ১৮ মার্চ ওই অফিস ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নানা অভিযোগ থাকার কারণে চেম্বারের নতুন পর্ষদে তাকে আর পরিচালক করা হয়নি।’
নগরীর বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘প্রতারণার মামলায় মুস্তাফিজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সকালেই তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যদি আরও অভিযোগ আসে, তাহলে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’