বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি টাকা ছাড়া মেলে না গেজেট-সম্মানি, পদে পদে হয়রানি (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪  : স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশ। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা, তাদের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি মেলেনি আজও। এখনো কেউ স্বীকৃতির জন্য, কেউ স্বীকৃতি পেলেও ভাতার জন্য ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। তাদের হাহাকার শোনার কেউ নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গেলে হয় বিরূপ অভিজ্ঞতা। অথচ যারা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন, তাদের সব হয়ে যায় অনায়াসে। এমনকি অনিয়ম-দুর্নীতির জেরে ফাঁকগলে কেউ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও পেয়ে যান স্বীকৃতি-ভাতা!

Advertisement

সাম্প্রতিক গেজেটে ভাতা পান না, উপজেলায় যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশ পেয়েছে এবং সুপারিশ পাননি- এমন তিন ক্যাটাগরির তিনজন মুক্তিযোদ্ধার আবেদন নিয়ে অনুসন্ধান করেছে জাগো নিউজ। উঠে এসেছে অনিয়মের মহাযজ্ঞ। উপজেলা থেকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুক)-সব জায়গায় টাকা ছাড়া নড়ে না ফাইল। টাকা না দিলে যৌক্তিক আবেদনেও সাড়া মেলে না। বাদ দিয়ে দেওয়া হয় বা ফাইলবন্দি পড়ে থাকে বছরের পর বছর।

টাকার বিনিময়ে সেবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন খোদ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীও। তবে তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও ভাতা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেছেন তিনি।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, অভিযোগগুলো যাতে ভালোভাবে বিচার হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের। তবে এই বিষয়টা বন্ধ হওয়া উচিত। একবারেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে তালিকা হয়নি।

শহীদের স্মরণে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ, তবু পরিবারের সদস্যদের সম্মানি পেতে হয়রানি

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামে। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে বরুড়া উপজেলা পয়ালগাছা ইউনিয়নের বটতলী এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। তিনিসহ পাঁচ শহীদের স্মরণে তাদের সমাধিস্থল বটতলীতে স্মৃতিস্তম্ভ করেছে সরকার। সেখানে পাঁচ শহীদের এক নম্বরে তার নাম।

আপিলে সাক্ষী দিতে বাবার সহযোদ্ধারাই টাকা দাবি করেন। তারা বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার রক্ত এখন মুক্তিযোদ্ধারা খায়।’ তাদের দাবি করা টাকা দিয়ে সাক্ষ্য নিয়ে আপিল করছি। তখনও জামুকা থেকে এক কর্মকর্তা দুই লাখ টাকার মধ্যে কাজটি করে দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু আমি বাবার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি টাকা দিয়ে নিতে রাজি হইনি। যার কারণে আপিলের আট বছরেও কোনো সাড়া পাইনি। অথচ আমার জানামতে ৭/৮ জন টাকা দিয়ে করে নিয়েছে।–বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছায়েদুর রহমান

 

মুক্তিযোদ্ধার গেজেটেও তার নাম আছে। আছে লাল মুক্তিবার্তা ও বেসামরিক গেজেটেও। এমনকি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি বাস্তবায়ন কমিটি ৫ নভেম্বর ২০২২ তারিখে তার পরিবারের অনুকূলে ভাতা দিতে সুপারিশও করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তার ‘বেসামরিক গেজেট নম্বর- ১২৪৯ জামুকার সুপারিশকৃত নয় জানিয়ে তার অনুকূলে এ মুহূর্তে সম্মানি ভাতা বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই’ বলে ১২ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে উপজেলাকে জানায়।

Advertisement

শহীদের নাতি মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা নিয়ে নানার সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারকে নিয়ে দফায় দফায় জামুকা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এমনকি মন্ত্রীর কাছে গিয়েও সমাধান পাইনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যের গানম্যান মানিক মিয়া এ কাজটি করে দিতে প্রথমে চার লাখ, পরে তিন লাখ টাকা দাবি করেন।’

বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

এ নিয়ে মানিক মিয়ার সঙ্গে কথা বললে তিনি এই প্রতিবেদককেও ফাইল নিয়ে দেখা করতে বলেন। এছাড়া একাধিক মাধ্যমে ওই গানম্যানের অর্থের মাধ্যমে কাজ করে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে।

একই বিষয়ে ২৪ মার্চ ২০২৪ তারিখে জামুকায় গেলে মহাপরিচালকের দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর (ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্বে) হাফিজ আহম্মদ বলেন, ‘ঈদের পরে আসেন, দেখবো।’ একই সঙ্গে উপজেলাকে বেসামরিক গেজেটের পাশাপাশি লাল মুক্তি বার্তার নম্বর উল্লেখ করে ফের সম্মানির জন্য সুপারিশ করতে বলেন।

‘টাকা ছাড়া সাক্ষী, সুপারিশ ও অনুমোদন মেলে না’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন। ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। তার প্রমাণস্বরূপ আছে ওসমানী সনদ। মুক্তিবার্তা সবুজ বইয়ে আছে তার নামও। নম্বর ০২০৪০৪০৪৪৪। সহযোদ্ধারা উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে এসে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। কিন্তু কমিটির সভাপতি তিন লাখ টাকা দাবি করেন, তা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় সুপারিশে তার নাম দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তার ছেলে ছায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন এমপি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন। তার পিএ আবির ফোন করে আমার কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেন। এবং আমাকে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসমাজে যোগ দিতে বলেন। আমি বলেছি, ছাত্রলীগের নেতা হয়ে আমি ছাত্রসমাজ করবো? আর টাকাও দেওয়া সম্ভব নয়। শুনেছি সুপারিশে যাদের নাম দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকেও ২/৩ লাখ করে টাকা নিয়েছেন এমপি।’

 

‘ক’ তালিকার শুনানি চলছে। বাকিটা শুনানি শুরু হয়নি। মন্ত্রী আমাদের কাছে কিছু পাঠালে আমরা স্পেশাল কমিটিতে দেই। কখনো মঞ্জুর হয় বা বাতিল হয়। এখানে কোনো স্টাফ চাইলে স্বীকৃতি দিতে পারবে না। মিটিংয়ে অনুমোদন হতে হবে। যা করেন, সদস্যরা করেন। উপজেলার সুপারিশেরগুলো হচ্ছে। এর বাইরে এখনো হয়নি।-জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক জহুরুল ইসলাম রাহেল

উপজেলায় সুপারিশবঞ্চিত হয়ে আপিল করেন আমির হোসেনের ছেলে ছায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আপিলে সাক্ষী দিতে বাবার সহযোদ্ধারাই টাকা দাবি করেন। তারা বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার রক্ত এখন মুক্তিযোদ্ধারা খায়।’ তাদের দাবি করা টাকা দিয়ে সাক্ষ্য নিয়ে আপিল করছি। তখনও জামুকা থেকে এক কর্মকর্তা দুই লাখ টাকার মধ্যে কাজটি করে দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু আমি বাবার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি টাকা দিয়ে নিতে রাজি হইনি। যার কারণে আপিলের আট বছরেও কোনো সাড়া পাইনি। অথচ আমার জানামতে ৭/৮ জন টাকা দিয়ে করে নিয়েছে।’

Advertisement

বিষয়টি অনুসন্ধানে একাধিকবার জামুকায় গিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসে। জানা যায়, টাকা ছাড়া মেলে না কোনো সেবা। দেওয়া হয় না তথ্যও।