ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪ : দেশে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। হতাহতের ঘটনাও কম-বেশি ঘটেছে। এই অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তিন ধাপে কাজ করে। প্রথম ধাপে থাকে হকাররা। নির্ধারিত হকার ডাব, শরবত বা কোমল পানীয়ের সঙ্গে অজ্ঞান করার ট্যাবলেট সুকৌশলে মিশিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে খাইয়ে দেয়। খাওয়ার পর থেকেই তাকে অনুসরণ করতে থাকে অজ্ঞান পার্টির দ্বিতীয় ধাপের সদস্যরা। আর তৃতীয় ধাপের সদস্যরা টার্গেট করা ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে, তার সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ও মূল্যবান মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়। হাতিয়ে নেয়া টাকা পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী জমা হয় পার্টির প্রধানের কাছে।
Advertisement
পরে সেগুলো ভাগ-বাটোয়ারা হয়। অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত হয় আমদানি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ওষুধ। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ওষুধে সয়লাব পুরো মিডফোর্টের ওষুধ মার্কেট। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওইসব বিক্রি করে দিচ্ছে অপরাধীদের কাছে। সম্প্রতি অজ্ঞান ও মলম পার্টির ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব-৩। গ্রেপ্তাররা হলো- শাকিল (৩২), মিলন শেখ (৩২), রমজান আলী (২৭), ইমরান হোসেন (২৪), আরিফুল ইসলাম ওরফে ইমরান (৩২), মহসীন খারকোল (৪২), হারুনুর রশিদ লিমন (২২), আমজাদ (৪২), জিয়াউর রহমান (৩০) ও চিত্তরঞ্জন সরকার (৩১)। তাদের কাছে চেতনানাশক ওষুধ ছাড়াও পাঁচটি বিষাক্ত মলমের কৌটা, ৮০টি মোবাইল ফোন ও ২৫ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। টাকাগুলো টার্গেটকৃতদের চোখে মলম লাগিয়ে ও অচেতন করে হাতিয়ে নিয়েছিল। তাদের নারায়ণগঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে এখানে ভর্তি হচ্ছেন। চলতি মাসে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ২০ জন। যার মধ্যে গত ৬ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক কর্মকর্তাসহ অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনজন। ভর্তি হওয়াদের সবার কাছ থেকেই টাকা-পয়সা ও মূল্যবান মালামাল নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া গত ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর বকশীবাজার এলাকায় মৌমিতা পরিবহণের একটি বাস থেকে আল আমিন (৪৫) নামে এক যাত্রীকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃতু্য হয়। তিনি অজ্ঞান পার্টির কবরে পড়েছিলেন বলে চিকিৎসকরা জানান। গত ২০ জানুয়ারি অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়েন দৈনিক মানবজমিনের স্পোর্টস ইনচার্জ ও ক্রীড়া লেখক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুমন হোসেন (৩৭)। তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার সঙ্গে থাকা ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সিনিয়র টেকনোলজিস্ট আশিকুর রহমান অফিস শেষে মিরপুরের বাসায় ফেরার পথে বাসের হকারের কাছ থেকে হালুয়া কিনে খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। তার সঙ্গে থাকা ৩০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, ‘অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তিনটি ধাপে কাজ করে। প্রথম ধাপে থাকে হকার। দ্বিতীয় ধাপে অনুসরণকারী দলের সদস্যরা। আর তৃতীয় ধাপে মূল দুর্বৃত্তরা। যারা অচেতন হওয়া ব্যক্তির মালামাল লুট করে। এরপর টাকাগুলো জমা পড়ে অজ্ঞান পার্টির প্রধান নেতার কাছে।
Advertisement
অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে এটিভ্যান নামের এক ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে।’ র্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বড় ধরনের চুরি, ডাকাতি, কাউকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা, খুন ও অপহরণ করতেও চেতনা নাশক ট্যাবলেট ব্যবহার করে থাকে। এজন্য প্রতিটি বাস ও লঞ্চ টার্মিনালসহ রাজধানীর প্রায় সব জায়গায় পুলিশের পাশাপাশির্ যাবের তরফ থেকেও নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টার্মিনালগুলোতে থাকা সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেগুলোর ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অজ্ঞান বা অচেতন করতে এটিভ্যান নামক ট্যাবলেট ৫ ও ১০ মিলিগ্রাম ওজনের কমলা ও সাদা রঙের হয়ে থাকে। পার্শ্ববর্তী দুটি দেশে এগুলো তৈরি হয়। অবৈধভাবে ট্যাবলেটগুলো বাংলাদেশে আসে। ট্যাবলেটগুলোর প্রধান বাজার পুরান ঢাকার মিডফোর্ট মেডিসিন মার্কেটকে কেন্দ্র করে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, অজ্ঞান পার্টির কবল থেকে বাঁচার একমাত্র সহজ পথ ব্যক্তিগতভাবে সচেতন থাকা। প্রতিটি রেল, লঞ্চ ও বাস টার্মিনালে পুলিশ ওর্ যাবের তরফ থেকে মাইকিং করে অন্যের দেওয়া কোনো ধরনের খাবার না খেতে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে। এছাড়া অজ্ঞান পার্টির কবল থেকে রক্ষা পেতে সচেতনতামূলক নানা পোস্টার লাগানো হয়েছে। তারপরেও অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ার ঘটনা ঘটছে। ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, যেসব চেতনানাশক ওষুধ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে মানুষকে অজ্ঞান করা হয়, ওইসব ওষুধের বিরুদ্ধে পুলিশ ওর্ যাবের তরফ থেকে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে।
Advertisement
এক শ্রেণির অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী বৈধ ও অবৈধ দু’ভাবেই ওষুধগুলো আমদানি করে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ওইসব ওষুধ অপরাধীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এজন্য মনিটরিং জোরদার করতে বলা হয়েছে। হকারদের পরিচয়পত্র দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হকারদের পরিচয়পত্র দেওয়ার বিষয়টি খুবই জটিল। তবুও এ ব্যাপারে পরিবহণ সেক্টর ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করার বিষয় আছে। এছাড়া হকারদের পরিচয়পত্র দিলেই যে তারা অজ্ঞান পার্টির সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা কমাতে হকারসহ লঞ্চ, বাস ও ট্রেন স্টেশনে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহজাদা সেলিম যায়যায়দিনকে বলেন, অনেক সময় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা দ্রম্নত টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অজ্ঞান করতে অতিমাত্রায় চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে থাকে। যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। অনেক সময় দেখা যায় অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়া ব্যক্তি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তার আচার-আচরণ ও চলাফেরা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।