ভয়াবহ এবং একই সঙ্গে বিস্ময়করও বটে! নিজের শ্বশুরকে হত্যা দিয়ে শুরু। এরপর জড়িয়েছেন আরো নানা অপরাধে। ৩০ জনের বেশি ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছেন। এজন্য ব্যবহার করেছে সুন্দরী নারীদের। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে, জুয়েল নামে এমন এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীকে পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
Advertisement
রাজধানীতে বসেই ভয়ঙ্কর সব অপরাধ সংগঠিত করছিল জুয়েলের চক্র। প্রথমেই টার্গেট করা হতো সচ্ছল ব্যবসায়ীদের। এরপর ফেলা হতো প্রেমের ফাঁদে। কৌশলে বাসায় নিয়ে তোলা হতো অপ্রীতিকর ছবি। সেই ছবি-ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করা হতো মোটা অংকের টাকা। লেনদেনের মাধ্যম ছিল ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’। সাথে হুমকি দিয়ে মামলার পথ বন্ধ করতো।
Advertisement
এভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গড়ে ওঠা চক্রটি রাজধানীতে এসে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিকে টার্গেট করে অপহরণ করে অর্থ হাতিয়ে আসছিল। অবশেষে অভিযান চালিয়ে অপহরণকারী চক্রের ছয় সদস্য ধরা পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জালে।
এই চক্রের মূল হোতা ও পরিকল্পনাকারী জুয়েল রানা নামে এক ব্যক্তি। জুয়েলের কাজ ছিল পরিকল্পনার পাশাপাশি যাদের তারা অপহরণ করবে তাদেরকে খুঁজে বের করা।
শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবির নিজ কার্যালয়ে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, একটি অপহরণ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্য বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লিটন নামে এক কাপড় ব্যবসায়ীকে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করে চক্রটি। সেই ভুক্তভোগী থানায় মামলা করলে মামলার তদন্তে এই চক্রের সন্ধান পায় ডিবি।
Advertisement
ডিবি প্রধান বলেন, ঘটনার দিন জুয়েল রানা রাজধানী ডেমরার একটি বাসায় লাভলী নামের এক নারী এবং তার মেয়েকে দিয়ে এক ব্যবসায়ীকে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। পরে ঐ ব্যবসায়ীর সাথে লাভলী ও তার মেয়েকে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়ানোর অভিযোগে ওই বাসায় আটকে রাখে। জুয়েল ও তার সহযোগীদের টাকা দিয়ে মুক্ত হন ওই ব্যবসায়ী। মুক্ত হবার পর ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মামলা দায়ের করেন।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে গোয়েন্দা প্রধান জানান, লাভলী নামে এক মেয়ের সঙ্গে ফোনে পরিচয় হয় ব্যবসায়ী লিটনের। এরপর তার সঙ্গে কথার সূত্র ধরে লিটন ঢাকায় আসেন। সেই লাভলী লিটনকে তার মেয়ে সায়মার বাসায় নিয়ে যায়। ওই বাসায় অপহরণকারী চক্রের মূল হোতা জুয়েল রানাসহ সায়মা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকেন। যা লাভলী জানে। সায়মার বাসায় আগে থেকে কিছু মেয়ে রাখা হয়।
লিটনকে সেখানে নিয়ে চোখ হাত পা বেঁধে ফেলা হয়। পাশাপাশি সেই বাসায় থাকা মেয়েদেরও হাত-পা বেঁধে আরেকটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। লিটনকে বুঝানো হয় যে তাদের সবাইকে অপহরণ করা হয়েছে। এরপর খারাপ মেয়ে এনে তার সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তোলা হয়। এরপর জুয়েল রানা লিটনের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
কিন্তু সেই টাকা দিতে হবে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে। তবে এই টাকা দিতে হবে ডলারে। লিটন ক্রিপ্টোকারেন্সি বোঝেনা এজন্য তাকে পাঠানো হয় আরিফ নামে এক যুবকের কাছে। এরপর তারা তার কাছে গিয়ে ১০ লাখ টাকার ক্রিপটোকারেন্সি ডলারে কিনে চার লাখ টাকা পাঠিয়ে দেয় দুবাই বাকি ছয় লাখ টাকা জুয়েল রানা নিয়ে নেয়। যা ঢাকা মহানগর পুলিশ তার কাছ থেকে উদ্ধার করেছে।
তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ চক্রটি পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরের কোনো এলাকায় তাদের ব্যবহৃত ফোন ফেলে দিতো। জুয়েল রানা নামের একজন তাদের প্রধান সমন্বয়ক। নিজের শ্বশুরকে হত্যা করার মধ্যদিয়ে অপরাধীর খাতায় নাম লেখানো এই জুয়েলের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৮টি। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করে ব্যবসার কথা বলে নারীদের দিয়ে অপহরণ করে চক্রটি।
জুয়েল রানা নিজেই ৩০টি অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। মুক্তিপণের টাকা আদায় করেন তারা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে। জুয়েল রানার বাড়ি নবীনগর। ওই এলাকায় তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন গডফাদার হিসেবে পরিচিত। তার শ্বশুরকে হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে অপরাধ জগতে নাম লিখেছিল। এরপর তার নামে নবীনগরে একটি হত্যা মামলা হয়। তার নামে পাঁচটি ওয়ারেন্ট রয়েছে।
হারুন অর রশীদ বলেন, এই জুয়েল গেল জানুয়ারি মাসে একজনকে অপহরণ করে ১৬ লাখ টাকা আদায় করেছে। এছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর এলাকার ফারুক নামে এক লোকের ছেলেকে অপহরণ করে ৫০ লক্ষ টাকা আদায় করেছে। এভাবে জুয়েল বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা অপহরণ করে আদায় করেছে। শুধু তাই নয়, তারা যাদের অপহরণ করত তাদের আপত্তিকর ভিডিও রেখে দিতো।