নকশা বহির্ভূতভাবে ভবনের আয়তন বাড়ানোর অভিযোগে বেইলি রোডের আগুনে পোড়া গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে আগেও অভিযান চালিয়েছিলো রাজউক। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সেই অভিযানে ভবন মালিককে ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিলো। সেই সাথে কী কাজে ভবনটি ব্যবহার করা হবে সে সংক্রান্ত সনদ না নেয়ার কারণে রাজউকের নোটিশ পেয়েছিলো ভবনটি।
সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার মধ্যেই এ খবর সামনে এলো। জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের ২ নম্বর হোল্ডিংয়ের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটির নিচতলার বেজমেন্টের অবৈধ অংশে উচ্ছেদ চালায় রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেদিনের অভিযানে ভবনটির নকশা বহির্ভূত অংশ ভেঙে দেয়া হয়।
রাজউকের জোন ‘ছয় বাই এক’ -এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মো. নূরুজ্জামান হোসেন জাহির সাক্ষরিত এই নথি বলছে সেই অভিযানের পর পে-লোডারের ভাড়া ও এর জ্বালানি বাবত ভবন মালিককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
একই বছর ভবনটি কী কাজে ব্যবহার হবে তা জানিয়ে সনদ নিতেও নোটিশ দিয়েছিলো রাজউক। ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো ভবন নির্মাণের পর সেটি ব্যবহারের আগে অকুপেন্সি সনদ নিতে হয়।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত সে জায়গার কিছু অংশ ভেঙে ফেলে সেসময়। সেই সাথে আর্থিক জরিমানাও করা হয়।
রাজউকের নথি বলছে, ২০১১ সালে আটতলা ভবনটি রাজউকের অনুমোদন পায়। নিচতলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ও বাকি তিন তলা পর্যন্ত আবাসিক বা রাজউকের ভাষায় মিশ্র হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৩ সালে ভবনটির কাজ শেষ হবার পর বাণিজ্যিক ব্যবহারের ট্রেড লাইসেন্স নেয়া হলেও অকুপেন্সি সনদ নেয়নি ভবন কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীতে নকশা বহির্ভূত প্রায় চার লাখ ভবন আছে। এসব ভবনের অনেকগুলোতেই চলছে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট মার্কেট ও দোকানপাট। এসব ভবনে দ্রুতই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে রাজউক।
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজটি প্রথমে আবাসিক ভবন হিসেবে নির্মিত হলেও পরে তা বাণিজ্যিক কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু এবং সেখানে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ করায় ভয়াবহ আগুনে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
শুক্রবার পুলিশের মামলায়, ভবনটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে।
ইতোমধ্যে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের এক ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়েছে রমনা থানা পুলিশ।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ভবনটির মালিক ও ম্যানেজার সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট এবং দোকান ভাড়া দেন। রেস্টুরেন্টগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া রান্নার কাজে গ্যাসের সিলিন্ডার এবং চুলা ব্যবহার করে। রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য ভবনের মালিক ও ম্যানেজারের যোগসাজশে চুমুক, কাচ্চি ভাই, মেজবানী রেস্টুরেন্ট, খানাস ফ্ল্যাগশিপ, স্ট্রিট ওভেন, জেষ্টি, হাক্কা ঢাক্কা, শেখহলি, ফয়সাল জুসবার (বার্গার), ওয়াফেলবে, তাওয়াজ, পিৎজা–ইন, ফোকো এবং এম্ব্রোশিয়া রেস্তোরাঁর মালিকেরা ভবনটির নিচ তলায় বিপুল পরিমাণে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, তারা জননিরাপত্তা তোয়াক্কা না করে অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়া ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ এবং বিপজ্জনকভাবে এই গ্যাস সিলিন্ডার এবং গ্যাসের চুলা ব্যবহার করে আসছিলেন। এই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। এই আগুনের তাপ ও প্রচণ্ড ধোঁয়া পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা রেস্টুরেন্ট ও দোকানে অবস্থানকারী লোকজন আগুনে পুড়ে ও ধোঁয়া শ্বাসনালিতে ঢুকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান এবং গুরুতর আহত হন।
পুলিশ মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করে, ভবনটি আবাসিক ভবন হিসেবে নির্মিত হলেও পরবর্তীতে মালিক ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর ব্যবসায়িক কাজে পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়। ভবনটির যেসব তলায় রেস্তোরাঁ ছিলো, সেগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের জন্য ফায়ার সার্ভিসের কোনো অনুমোদন নেয়নি। এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি ভবনটিতে ফায়ার এক্সিট সিঁড়িও নেই।
ভবনের মালিক, ম্যানেজার ও রেস্তোরাঁর মালিকেরা ভবন ব্যবহারের যথাযথ নিয়ম মানেননি। তারা আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য ভাড়া দিয়েছেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দোকান পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রেস্তোরাঁ স্থাপন করে, গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহার করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। দগ্ধ হয়েছেন আরও ১১ জন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে। নিহতদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী এবং আট জন শিশু।