ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ,শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ : সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে বেশ কিছু ‘ডিপফেক’ ভিডিও ও ছবি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে এসব ভিডিও, যা ‘ডিপফেক’ নামে নেট দুনিয়ায় পরিচিতি হয়ে উঠেছে। এর মানে হচ্ছে, শরীর একজনের মুখ আরেকজনের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বলিউড তারকারাই সবচেয়ে বেশি ‘ডিপফেক’ মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু কেন?
Advertisement
ভাইরাল হওয়া এমন দু’টি ডিপফেক ভিডিওতে দেখা গেছে, এক বলিউড তারকা ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি- করছেন, আরেকজন স্বল্পবসনা হয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছেন। যদিও বাস্তবে এসবের কোন কিছুই ঘটেনি। আর ঘটনার সম্ভাবনাও নেই, কারণ সবাই প্রতিষ্ঠিত তারকা।
যাদের নিয়ে এমন সব ভুয়া ভিডিও তৈরি করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন দক্ষিণী নায়িকা রশ্মিকা মানদানা, প্রিয়াংকা চোপড়া ও আলিয়া ভাটের মতো তারকারা। বিতর্কিত কিছু ভিডিওতে বসিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের চেহারা বা কণ্ঠ। তাদের ছবিগুলো সাধারণত সামাজিক মাধ্যমগুলো থেকে নেয়া এবং অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হয়েছে।
বলিউডে এত এই ডিপফেক উত্থানের কারণটা কী?
ডিপফেক আগে থেকেই ছিলো এবং বহুদিন ধরে তারকাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এসেছে। এতদিন হলিউড এই আগুনে পুড়েছে- এমনটা জানিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ আরতি সামানি বিবিসিকে বলেন, নাটালি পোর্টম্যান বা এমা ওয়াটসনের মতো হাই প্রোফাইল অভিনেত্রীরা এর শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি এআই প্রযুক্তির উন্নতির কারণে মানুষের ভুয়া অডিও ও ভিডিও তৈরি করার কাজ আরও সহজ হয়ে গেছে। গত ছয় মাস বা এক বছরে এই টুলগুলো আরও নিখুঁত হয়ে উঠেছে। এ কারণেই আমরা এই কন্টেন্টগুলো এখন অন্যান্য দেশেও বেশি দেখতে পাচ্ছি।
অনেক টুলই এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে জানিয়ে এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, ফলে খুব সামান্য খরচে বা খরচ ছাড়াই হুবহু বাস্তবধর্মী ছবি তৈরি করা যায় এবং এটা এখন সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে।
মিজ সামানি এর সাথে ভারতের কিছু একান্ত পরিস্থিতি যোগ করেন। দেশটির একটা বড় অংশ তরুণ, নেট দুনিয়াতে অবাধ বিচরণ, সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ব্যবহার এবং মারাত্মক রকমের বলিউড তারকা সংস্কৃতি। ফলে ভিডিওগুলো খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সমস্যাটাও বেশি করে ধরা পড়ে।
তিনি বলেন, ভিডিও বানানোর পেছনে মূলত দু’টি জিনিস কাজ করে। তার একটি হলো- বলিউড তারকাদের নিয়ে যে কোনো কিছু খুবই আকর্ষণীয় ক্লিকে পরিণত হয়, ফলে বিজ্ঞাপন থেকে অনেক আয় করা যায়। একই সাথে যারা এই ভিডিওগুলো দেখছে, তাদের অজান্তেই তথ্য বিক্রি করার একটা সুযোগ তৈরি হয়।
‘ব্যাপারটা খুবই ভয়ঙ্কর’
ফেক বা ভুয়া ছবি সাধারণত পর্নোগ্রাফি ভিডিওতে ব্যবহার হয়, কিন্তু ফেক ভিডিও যে কোনো কিছু থেকেই তৈরি করা সম্ভব। সম্প্রতি ২৭ বছর বয়সী দক্ষিণ ভারতের অভিনেত্রী রাশ্মিকা মানদানার একটা ইন্সটাগ্রাম ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে কালো পোশাক পরা এক নারীর শরীরে তার চেহারাটা বসিয়ে দেয়া হয়।
পরে অবশ্য ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম অল্ট নিউজের এক সাংবাদিক রিপোর্ট করেন যে, এই ভিডিওটি আসলে ডিপফেক। রাশ্মিকা এই ঘটনাকে ‘খুবই ভয়ের’ বলে বর্ণনা করেন এবং মানুষকে এ ধরনের জিনিস শেয়ার না করার অনুরোধ জানান।
আরেক তারকা প্রিয়াংকা চোপড়ারও একটা ভিডিও সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে তার চেহারা নয় বরং কণ্ঠ বদলে দেয়া হয় যেখানে তিনি একটা ব্র্যান্ডের প্রচার চালাচ্ছেন এবং কিভাবে বিনিয়োগ করতে হবে সে সম্পর্কেও ধারণা দিচ্ছিলেন।
একই রকম ডিপফেকের শিকার হয়েছেন অভিনেত্রী আলিয়া ভাটও। এক ভিডিওতে দেখা গেছে, তার মতোই দেখতে একজন ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছেন। এছাড়া ক্যাটরিনা কাইফও লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। এক্ষেত্রে ‘টাইগার থ্রি’ চলচ্চিত্র থেকে তার একটা ছবি, যেখানে তিনি টাওয়েল পেঁচিয়ে আছেন, সেটাকে আরেকটা পোশাকে বদলে দেয়া হয়েছে যাতে তার শরীর আরও বেশি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
Advertisement
শুধু বলিউড তারকাই নয় অন্যরাও এর শিকার হচ্ছেন, সম্প্রতি ভারতীয় শিল্পপতি রতন টাটার একটা ডিপফেক ভিডিও বানানো হয় যেখানে তিনি বিনিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন।
সাধারণত নারীই বেশি করে ডিপফেক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেনসিটি এআই বলছে এসব ডিপফেকের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই হল অনুমতিবিহীন পর্নো। আর এর বেশিরভাগ শিকার নারীরা। ভারতীয় প্রযুক্তি সেবা ও কনসাল্টিং কোম্পানি উইপ্রো’র গ্লোবাল চিফ প্রাইভেসি অফিসার ইভানা বার্তোলেতি বিষয়টিকে ভয়ংকর বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, নারীদের জন্য এটা বেশি সমস্যার কারণ এগুলো ব্যবহার করে পর্নো বা সহিংসতার ভিডিও বানানো হয়, আর আমরা জানি যে এসবের একটা বাজার আছে। এই সমস্যাটা সব সময়ই ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে যেটা দুশ্চিন্তার কারণ তা হলো, এসব টুলের সহজলভ্যতা ও কাজের গতি।
মিজ সামানিও বলছেন, ডিপফেকের সংকটটা নারীদের জন্য ভয়ংকর মাত্রার। নারীদের মূল্যায়নই করা হয় তার সৌন্দর্য দেখে এবং নারী শরীর হয় লক্ষ্যবস্তু।
ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ
ডিপফেক ভিডিওগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন সরকার ও টেক কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে এ ধরণের কন্টেন্ট বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। ভারতীয় সরকার নির্বাচন সামনে রেখে ডিপফেকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
মানদানার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ডিপফেকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন ভারতের প্রযুক্তিমন্ত্রী রাজিব চন্দ্র শেখর। তিনি বলেন, এগুলো হলো মিথ্যা তথ্যের একেবারে সাম্প্রতিক এবং আরও ভয়ংকর ও ক্ষতিকর উদাহরণ। এর বিরুদ্ধে প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভারতীয় প্রযুক্তি আইনে, সামাজিক মাধ্যম সাইটগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো ব্যবহারকারীর দ্বারা যেন কোনো মিথ্যা তথ্য পোস্ট করা হচ্ছে না। যেসব প্ল্যাটফর্ম এটা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হবে আইন অনুযায়ী তাদের আদালতে নেয়া যেতে পারে।
কিন্তু মিজ বার্তোলেতি বলেন, শুধু ভারত নয় এই সমস্যাটা আরও বিরাট আকার ধারণ করেছে, সারা বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন দেশ এই সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজছে।
তিনি বলেন, শুধু বলিউড তারকাদেরই নয়, ডিপফেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং অন্য লোকেদেরও লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। বিশ্বের অনেক সরকারকেই এখন চিন্তা করতে হচ্ছে যে ডিপফেকের প্রভাবে নির্বাচন ও গণতন্ত্রেও প্রভাব পড়তে পারে।
সামাজিক মাধ্যমকে এক্ষেত্রে দায় স্বীকার করতে হবে এবং ডিপফেক শনাক্ত ও সেগুলো সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও জানান তিনি। আর এক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতাকেও দায়ী করেছেন সামানি।
Advertisement
তিনি বলেন, ঘটনার শিকার যারা হচ্ছেন তারা এ নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছেন ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন, কিন্তু খুবই কম পুরুষ এ নিয়ে কথা বলছে। এসব বন্ধে পুরুষদের দিক থেকে আরও সহযোগিতা এবং পদক্ষেপ আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
অভিনেত্রী রশ্মিকা মান্দানার একটি ডিপফেক ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হয়েছে। ছবি: বিবিসি