ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ,মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ : বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার বহুল আলোচিত মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ওই হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই আলোচনায় এসেছিলেন তার সময়ে একের পর এক ক্রসফায়ার আর তার কঠোরতার জন্য।
(মেজর সিনহা)
সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের আশীর্বাদ আর স্থানীয় কিছু রাজনীতিকের অন্ধ সমর্থন তাকে ওই এলাকায় বেপরোয়া করে তুলেছিলো বলে মনে করেন স্থানীয়দের অনেকে।
মাদক দমনের নামে একের পর এক ক্রসফায়ারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর মৃত্যুর পর স্থানীয়ভাবে দলটির এক পক্ষ ভয়ে আর অন্য পক্ষ নিজ স্বার্থে মি. দাশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন দলটির স্থানীয় নেতাদের কয়েকজন।
স্থানীয় রাজনীতিকরা বলছেন সব মিলিয়ে টেকনাফে একটি ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তারা বলছেন একদিকে ইয়াবাসহ মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছিলো আর অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে অনেকটা ‘যা খুশী তাই করার’ সুযোগ পেয়েছিলেন টেকনাফ থানার এই সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে পুলিশে যোগ দেয়া প্রদীপ কুমার দাশ চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানায় কর্মরত থাকার সময়েই ২০০৪ সালে এক নারীর জমি দখলের ঘটনায় বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে কক্সবাজারের চকরিয়ার এস আই হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপর জেলার মহেশখালীতে ও সর্বশেষ টেকনাফের ওসি হিসেবে কাজ করেন।
(খুনি ওসি প্রদীপ)
প্রদীপ দাশের বিরুদ্ধে মামলার কী হবে
সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগে কক্সবাজারে ‘অসহায় নির্যাতিত জনগণ’ এর ব্যানারে যে মানববন্ধন হয়েছে সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী অভিযোগ করেছেন যে ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে টেকনাফে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে দেড় শতাধিক মানুষ।
দিনের পর দিন এভাবে একের পর এক ক্রসফায়ার সহ নানা ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন, স্থানীয় রাজনীতিক কিংবা অন্যরা কেউ কোন কথা বলেনি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয়রা অনেকেই বলেছেন ওসি প্রদীপ দাশ ছিলেন সেখানকার সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠ।
মি বদির স্ত্রী শাহীন আখতার এখন সেখানকার সংসদ সদস্য।
মি বদি অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলছেন তিনি একাধিকবার ওসির এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সরকারের যথাযথ মহলে জানিয়েছেন।
“সরকার তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মাদক নির্মূলে। সেই সুযোগটাই প্রদীপ নিয়েছিলো। আমরা যখনই বলেছি তখন বলা হয়েছে মাদক নির্মূলে তাকে দরকার। সেজন্য আগে জানালেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি,” মিস্টার বদি বলছিলেন বিবিসি বাংলাকে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল বশর বলছেন তার দলেরই একটি অংশ প্রদীপের সহযোগিতায় টেকনাফে রাজত্ব কায়েম করেছিলো এবং পুলিশ প্রশাসনকে বারবার জানালেও তারা তাতে কর্ণপাত করেননি।
“আমি উপজেলা ও জেলার সব মিটিংয়ে অনেকবার বলেছি ওসির কর্মকাণ্ডের কথা। কিন্তু কেউ তাতে গুরুত্ব দেয়নি। প্রদীপ আমাদের দলের মধ্যেই তার অনুগত গ্রুপ তৈরি করে নিয়েছিলো,” বলছিলেন তিনি।
সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যা ছাড়াও প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে আরও অনেকগুলো মামলা হয়েছে।
Advertisement
ক্রসফায়ার আর নির্যাতন
স্থানীয়দের অভিযোগ তিনি টেকনাফের ওসি থাকাকালীন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১৪৫ জন।
সিনহা হত্যার ঘটনার পর ২০২০ সালের অগাস্টে কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছরের ১২ অগাস্ট থেকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে ১২টি মামলায় ১৫টি হত্যার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
এই ক্রসফায়ার নিয়ে সংবাদ করায় এক সাংবাদিককে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগেও মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
মি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও চলমান আছে। ইতোমধ্যে দুর্নীতি মামলার অভিযোগও গঠন করেছে আদালত।
এখন এসব মামলার বিষয়ে কি হবে তা নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন যে বাকী মামলাগুলোও আইন অনুযায়ী চলবে।
টেকনাফে কীভাবে এত প্রভাব?
কক্সবাজার সহ সারাদেশে ইয়াবাসহ মাদক ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে মাদকের বিষয়ে সরকারের নীতি ছিলো জিরো টলারেন্স।
তখন ইয়াবার অন্যতম রুট টেকনাফে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন পুলিশ অফিসার খোঁজা হয়েছিলো এবং প্রদীপ কুমার দাশকেই সে দায়িত্ব দিয়েছিলো সরকার।
স্থানীয় একজন রাজনীতিক বলছেন, “এ আস্থাই আসলে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের এ নির্ভরতার সুযোগে তিনি এমন কোন অন্যায় নেই যা করেননি। তার সমালোচনা করায় আমার দলের অনেক কর্মীকে খুন করিয়েছেন মাদক লেবেল দিয়ে। কারও সাহসই ছিলোনা তার বিরুদ্ধে কিছু বলার”।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজন জানিয়েছেন কথায় কথায় সরকারের উচ্চ মহলের কথা বলে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলকে অনেকটা নিজের আজ্ঞাবহ করে তুলেছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ।
আব্দুর রহমান বদি বলছেন ইয়াবা প্রতিরোধে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকেই মিস্টার দাশকে ব্যাপক সমর্থন দেয়া হয়েছিলো।
“আমি নিজেও তাকে সতর্ক করেছিলাম। সরকারকেও জানিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ হয়নি,” বলছিলেন তিনি।
টেকনাফের উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলছেন দলীয় ফোরামে বহুবার এ প্রসঙ্গে কথা হয়েছে কিন্তু ব্যবস্থা নেয়ার মতো পরিস্থিতি তখন ছিলোনা।
“আমরা আমাদের মতো বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ শোনেনি।”
আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক নূরুল বশর বলছেন দলের একটি অংশও মিস্টার দাশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং এ কারণেই একবার বদলী করার পরে সেই বদলীর আদেশ বাতিল করানো হয়েছিলো।
Advertisement
রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের কয়েকজন বলছেন যে টেকনাফে প্রদীপ কুমার দাশ এমন একটি ধারণা তৈরি করেছিলেন যে ‘মাদক দমনে তিনি যা খুশী তাই করতে পারেন’ এবং সরকার এটিই চায়।
“পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে তাকে। ফলে অন্য সংস্থাগুলোও তেমন একটা কাজ করতে পারেনি,” বলছিলেন স্থানীয় একজন সাংবাদিক।
প্রচলিত ব্যবস্থা কাজ করেনি কেন
সাধারণত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রম মনিটর করার গোয়েন্দা কার্যক্রমও সেই বাহিনীতে থাকে। পাশাপাশি অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও প্রতিটি থানায় কাজ করেন।
“তিনি এতো ক্ষমতা দেখিয়েছেন যে হয়তো অন্য সংস্থাগুলোর সেই সাহসই হয়নি তার বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট দেয়ার,” বলছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল বশর।
একজন কর্মকর্তা থানার ওসি থাকার সময়ে দেড়শর মতো মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যা, নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ আগেই ছড়িয়ে পড়লেও তা কেন পুলিশ প্রশাসনের নজরে পড়লোনা তা নিয়ে আলোচনা তখনো ছিলো এবং এখনও আছে।
কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তবে অন্য পেশার কয়েকজন বলছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজিরবিহীন সমর্থন উপভোগ করেছেন মি দাশ।
কোন ঘটনা ঘটিয়ে তিনি যেভাবে যা বলেছেন সেটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করেছেন এবং এমন অনেক ঘটনায় রিপোর্ট করার কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভৎর্সনা শুনেছেন কয়েকজন সাংবাদিকও।
আবার ক্ষমতাসীন দল, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মধ্যে নিজের অনুগত একটি গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন তিনি।
সবমিলিয়ে প্রদীপ কুমার দাশের ক্ষেত্রে পুরো সিস্টেমটাই ভেঙ্গে পড়েছিলো এবং এর ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলো অসীম ক্ষমতার অধিকারী।
সাবেক এডিশনাল আইজি মোখলেসুর রহমান অবশ্য বলছেন পুলিশে সুপারভিশনের একটি কাঠামো আছে এবং তিনি বীকার করেছেন স্প্রদীপ কুমার দাশের বিষয়টি আগেই তাদের নজরে আসা উচিত ছিলো।
Advertisement
“এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে পুলিশ ছাড়াও। তারাও কেন শক্তভাবে তার বিষয়ে সরকারকে অবগত করেনি সেটি বড় একটি প্রশ্ন। তবে সে মাদক দমনে ভালো করছিলো বলে হয়তো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছোটোখাটো অনেক কিছু আমলে নেননি,” বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন,” পুলিশ তো শুধু একা কোনো এলাকায় কাজ করে না। সব গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ করছে। যেহেতু রিপোর্ট আগে আসেনি তার মানে হলো তার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি। প্রশ্ন উঠলে নিশ্চয়ই আলোচনায় আসতো।”