ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি ,শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েও নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম।
রোববার শুনানি শেষে তার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আর এর তিন দিন পর বুধবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
Advertisement
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হিরো আলম, ‘১৭ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন করব।’
এ সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো ধরনের ভয়ভীতি বা অন্য কোনো কারণ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেন প্রত্যাহার করব তা ১৭ তারিখেই গণমাধ্যমে জানাব। আপাতত ধরে নিন নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছি।’
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, গুঞ্জন উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আপনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, সত্যি কিনা?
জবাবে তিনি বলেন, আমি যেখানে প্রার্থী হয়েছি সেখানে আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মতো প্রার্থীই নেই। তাহলে তারা আমাকে কেন টাকা দিতে যাবে। তারা তো আমাকে ভয় পায়। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা এমনিতেই হেরে যাবে। তাহলে টাকা নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসে না।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে হিরো আলম বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অনেক গুলো কারণ আছে। আমি যেহেতু ভোটারদের আশ্বাসে এমপি প্রার্থী হয়েছিলাম, সেহেতু ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর সুস্পষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে আমাকে। আমি আগামী রোববার গণমাধ্যমকে সেই কারণ বাখ্যা করে জানাবো।
এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর হলফনামাসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্রে স্বাক্ষর না করাসহ নানা ত্রুটির কারণে যাচাই-বাছাই শেষে তার মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। পরে মনোনয়নপত্রের বৈধতা ফিরে পেতে গত ৬ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন তিনি। ১০ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্রের বৈধতা ফেরতের আপিল মঞ্জুর করে তার পক্ষে রায় দেয় নির্বাচন কমিশন।
বাংলাদেশ কংগ্রেস টিকেটে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন আশরাফুল হোসেন। এই দলের নেতৃত্বাধীন জাতীয় জোটের ছয় দলের মধ্যে আছে গণ অধিকার পার্টি (পিআরপি), বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ গ্রিন পার্টি ও বাংলাদেশ সৎ সংগ্রামী ভোটার পার্টি।
যত নির্বাচনে হিরো আলম
হিরো আলম এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে একতারা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে বগুড়া-৪ আসনে ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাসদের এ কে এম রেজাউল করিমের কাছে ৮৩৪ ভোটে হেরে যান তিনি।
Advertisement
এরপর ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে হেরে গেলেও নির্বাচনের দিন তার ওপর হামলার অভিযোগ সামনে আসে।
তখন এ হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় বেশ কয়েকটি দেশ। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসও হিরো আলমের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে টুইট করেছিলেন।
এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হিরো আলম জাতীয় পার্টি থেকে বগুড়া-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়নপত্র কেনেন। পরে দলটি থেকে মনোনয়ন না পাবার পর বগুড়া-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেবার দুই দফায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। পরে উচ্চ আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
তবে নির্বাচনের দিন কারচুপি ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি। নির্বাচনে তিনি পান ৬৩৮ ভোট এবং মোট প্রদত্ত ভোটের এক অষ্টমাংশ ভোট না পাবার দরুন তার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়।
২০১৯ সালের মে মাসে তিনি জাতীয় পার্টির সাংস্কৃতিক অঙ্গসংগঠন জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন।
কে এই হিরো আলম
হিরো আলমের পুরো নাম আশরাফুল হোসেন সাঈদ, তিনি একাধারে একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, সঙ্গীত ভিডিও মডেল, অভিনেতা, গায়ক, রাজনীতিবিদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচিত ব্যক্তি। বিভিন্ন গান গাওয়ার জন্যই আলোচিত, সমালোচিত। গানের গলার কারণে তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট মিমের উপাদানেও পরিণত হয়েছেন। তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ১৬ লক্ষের বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।
আশরাফুল আলম সাঈদ ১৯৮৫ সালের ২০ জানুয়ারি বগুড়া জেলার সদর উপজেলার এরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার বাবা-মা তাকে একই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের পরিবারে পালক সন্তান হিসেবে তুলে দেয়। এই পরিবারেরও যথেষ্ট আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই তিনি জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা শুরু করেন।
প্রথম দিকে নিজ গ্রাম এরুলিয়ায় সিডি বিক্রির কাজ করলেও পরে স্যাটেলাইট টিভি সংযোগের (ক্যাবল পরিচালনা) ব্যবসায় নামেন তিনি। ডিশ ব্যবসা করতে করতেই শখের বশে সঙ্গীত ভিডিও নির্মাণ শুরু করেন হিরো আলম। ইউটিউবে আপলোড করা তার গানের ভিডিও নিয়ে ২০১৬ সালের দিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে প্রচুর ট্রল এবং মিম তৈরি শুরু করলে দ্রুতই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।
এরপর বিবিসি হিন্দি, জি নিউজ, এনডিটিভি, মিড-ডেসহ ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ফলে তিনি ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাঝে আলোচিত হন। ইয়াহু ইন্ডিয়ার এক জরিপ অনুসারে সেসময় ভারতীয় অভিনেতা সালমান খানের চেয়ে আলমকে বেশিবার গুগলে অনুসন্ধান করা হয়েছে।
১১ আগস্ট ২০১৭ তারিখে আশরাফুল আলম অভিনীত প্রথম ছবি মার ছক্কা মুক্তি পায়। ২০১৮ সালে তিনি বিজু দ্য হিরো নামে একটি বলিউড চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এছাড়া বাংলাদেশে বেশকিছু বিজ্ঞানপনচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
২০১৮ সালের গুগল অনুসন্ধানের প্রবণতায় বাংলাদেশে দশম অবস্থানে থাকেন হিরো আলম। ১৬ অক্টোবর ২০২০ মুক্তি পায় হিরো আলমের দ্বিতীয় সিনেমা ‘সাহসী হিরো আলম’। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন এ আর মুকুল নেত্রবাদী আর প্রযোজনা করেন হিরো আলম নিজেই। হিরো আলমের বিপরীতে অভিনয় করেন তিন নায়িকা সাকিরা মৌ, রাবিনা বৃষ্টি ও নুসরাত জাহান।
Advertisement
২০২০ সালের পরে হিরো আলম গান গাওয়ার প্রতি মনোনিবেশ করেন ও তার প্রথম গান ছিলো “বাবু খাইছো”। এরপর তিনি বেশ কিছু গান ও ভিডিও ইন্টারনেটে ছাড়েন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নজরুলগীতি।
তবে হিরো আলমের বিরুদ্ধে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নজরুলগীতি বিকৃত করে গাওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালের ২৭ জুলাই, বাংলাদেশে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা হিরো আলমকে তাদের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে যায়। পরে কখনও অনুমতি ছাড়া পুলিশের পোশাক পরবেন না, বিকৃত করে রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত গাইবেন না মর্মে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। ছাড়া পেয়ে হিরো আলম বাংলাদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে তার প্রতি মানসিক নির্যাতন ও অশোভন আচরণ করার অভিযোগ আনেন।