ঢাকা টাইমসকে ডা. নুজহাত চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে হবে (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি ,বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ : শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে চারটায় রাজাকার-আলবদর বাহিনী তার বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। রাতভর নির্যাতন শেষে ভোরে মেরে ফেলা হয়। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ১৮ ডিসেম্বর তার ক্ষতবিক্ষত লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। দেশের জন্য তার সংগ্রাম- স্বপ্ন ও স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে কথা হয় তার ছোট কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পার সঙ্গে। বাবার দেশ ভাবনা নিয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা বলেন, তখন আমি বেশ ছোট। বাবাকে নিয়ে আমার নিজের কোনো স্মৃতি নেই। তবে আমার মা ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি ভাষার অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার এবং নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করার অধিকারসহ সব ধরনের অধিকারের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তারা। জাতিকে সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে বুদ্ধিবৃত্তিক যে চর্চা তা বাস্তবায়নে যারা একসঙ্গে কাজ করছিলেন তাদেরই পরবর্তী সময়ে বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে আমার বাবাও ছিলেন।

Advertisement

একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে হত্যার মতো ঘৃণিত ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি জানিয়ে তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ মারা হয়েছে। সেই মানুষরা ইহুদি ছিল বলে তাদের মারা হয়েছে। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন মেধাবী ইহুদি ছিলেন বলে তার মতো অন্যদের তালিকা তৈরি করে সেই মেধাকে হরণ করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বেছে বেছে মেধাবীদের হত্যা করা হয়েছে।

ডিসেম্বরের শুরুতে যখন পাকিস্তানিরা বুঝে গিয়েছিল আমাদের রাজনৈতিক বিজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, তখন মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা করা হয়। মেধাশূন্য বলতে এই দেশটাকে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দেশ হিসেবে যেন তৈরি না করতে পারে সেজন্য বিভিন্ন পেশার সবচেয়ে মেধাবী, সফল এবং একইসঙ্গে দেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি মেধা ও মননের দিকে ভূমিকা রাখছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হয়। পৃথিবীর সমগ্র দ্বন্দ্বের যে ইতিহাস পড়েছি এর মধ্যে এমন ঘৃণিত ঘটনা হয়তো কখনোই ঘটেনি।

বুদ্ধিজীবীদের হত্যা একটা জাতির বিরুদ্ধে নিগূঢ় কূটচাল উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা জাতিকে যুদ্ধে পরাজিত করতে না পেরে তার ভবিষ্যতকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এমন অপরাধের যে চলমান প্রভাব রয়েছে এটা এই জাতিকে বুঝতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ভাষা সৈনিক ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বাবাও ভাষা সৈনিক ছিলেন। সেই সময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। আমরা জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খুব ভালো সংযোগ ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের। আমার বাবা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সেই মিছিলেও ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বাবাদের ২০ এবং ২১ নম্বর যে কক্ষ ছিল তার সামনেই বরকতের খুলি উড়ে এসে পড়েছিল। বাবা কালো পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে জেলেও গিয়েছেন। সুতরাং তাদের অবদান একমুখী কিংবা একদিনের নয়, বহুমুখী বহু দিনের ছিল।

ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, বাবা বিলেতে শুধু পড়াশোনাই করেননি সেখানে চাকরিও করতেন। আজীবন সেখানে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু দেশে ফিরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন।

Advertisement

পরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও চিকিৎসা সেবায় অবদান রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা হবে- এমন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবার বোঝাপড়া বেশ ভালো ছিল। আফসোস এই দেশে বাবার চিকিৎসা ভাবনার প্রতিফলনের সুযোগ হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধুকেই মেরে ফেলা হলো। একজন মাথা ব্যথার জন্য সবচেয়ে ভালো চিকিৎসক পেয়ে যাচ্ছেন কিন্তু একজন রিকশাওয়ালা ব্রেইন টিউমার নিয়ে পথে পড়ে থাকলেও তার চিকিৎসা হচ্ছে না। তবুও আশা রাখি, ধীরে ধীরে আমরা সেই প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছতে পারবো।

বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা জানিয়ে ডা. নুজহাত বলেন, স্বাধীন দেশ নিয়ে আমাদের যে স্বপ্ন ছিল তা থেকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। কারণ যিনি আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন তাকেই হত্যা করা হয়েছে। তার অবর্তমানে যারা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন সেই জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে।

যে বাঙালি এত প্রগতিশীল ছিল তাদের সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত করেছে। এক পাত্রে এক ফোঁটা বিষ পড়লেও তা বিষাক্ত হয়ে যায়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এই বিষ থেকে ধীরে ধীরে পরিশোধিত হয়ে সোনার বাংলার স্বপ্নে পৌঁছতে বহু বছর সময় লাগবে। সবচেয়ে বড় বিষয় যে আমরা আদর্শিক অর্জন ফিরে আসতে দেখি। তাই এই দেশ নিয়ে আশাবাদী।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শীর্ষস্থানীয় দু-চারজনের বিচার হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগেরই হয়নি। এই বিচার চলমান থাকতে হবে। একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে শেষ যুদ্ধাপরাধী যে বেঁচে আছে তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তা সম্পন্ন হবে না।

দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীর পাশাপাশি সমান গুরুত্ব বহন করে সেই অপরাজনীতি, যা ৩০ লাখ মানুষকে মারতে দ্বিধা করেনি। সাম্প্রদায়িক শক্তি অর্থাৎ জামায়াত-শিবিরের নিবন্ধন বাতিল করেছি। কিন্তু নিবন্ধন তো নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো দলগুলোর রাজনীতি বন্ধের জন্য কোনো উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার এখনো বাকি।

Advertisement

এখানে দুটো বিষয়- প্রথমত, জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে বিচার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাংলার মাটিতে বন্ধ করতে হবে।