ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ : ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এক আতঙ্কের নাম সেলফী পরিবহন। গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়াঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার পথে চলাচলা করা মানুষের কাছে এই বাস যেন যমদূত! কিছুদিন পরপরই নানা দুর্ঘটনায় ঘাতকের ভূমিকায় নাম উঠে পরিবহনটির। সবশেষ ধামরাইয়ে সেলফী পরিবহনের বাসচাপায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রুবেল পারভেজ নিহত হলে আবারও উঠে আসে আলোচনায়।
Advertisement
এই সড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার অর্ধেকের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত সেলফী পরিবহনের বাস। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের শুরু থেকে ওই বছরের জুলাই পর্যন্ত, সাত মাসে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০টি। নিহত হয়েছে ২৯ জন। আহত হয় ১০০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে ২৫টি দুর্ঘটনায় সেলফী পরিবহনের বাসের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
কিন্তু বারবার দুর্ঘটনা ঘটালেও কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে এই পরিবহন কোম্পানিটি? সময় সংবাদ এই পরিবহনের কমপক্ষে ১০ জন চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, মূলত অস্বাভাবিক চাঁদাবাজি এবং প্রশাসনের ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার কারণেই দাপটের সাথে মহাসড়কে চলে এই সেলফী পরিবহন।
গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাটের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের হিসাবে, এই পথে যে পরিমাণ যাত্রী আছে তাতে সবমিলে ১০০ বাস চলাচল করলেই যথেষ্ট। কিন্তু দিনে তার দ্বিগুণ বাস চলাচল করে। এতে প্রতিটি গাড়ির গাবতলী বা পাটুরিয়া ঘাট থেকে ছাড়ার সময় কমে যায়।
এক সময় দূরপাল্লার বাস চালাতেন আব্বাস। পরে যুক্ত হন সেলফী পরিবহনে। তার হিসেবে, সেলফী পরিবহনে চলাচল করা প্রায় সব বাসেই ৪০ থেকে ৪৫টি সিট আছে। একটি বাস দিনে একবার যাওয়া-আসা করতে পারে। অর্থাৎ, গাবতলী থেকে পাটুরিয়া, আবার সেখান থেকে ঘুরে গাবতলী। এতে তেল খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকার, রাস্তার খরচ (চাঁদা) তিন হাজার টাকা, চালক-সুপারভাইজার এবং হেলপারের খাওয়া বাবদ দিনে এক হাজার এবং বেতন তিন হাজার টাকা।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘সবমিলে একটি বাসে ১২ হাজার টাকা দিনের খরচ। এরপর মালিক একটা বাস কিনছেন, তারও তো আশা থাকে দিন শেষে দুই-তিন হাজার টাকা পাবেন। তাহলে একটা বাসের ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করতে হয় প্রতিদিন। এখন বাস যদি সিটিং যেতে পারে আবার ঘুরে আসতে পারে তাহলে পোষায়। কিন্তু টার্মিনালে আমরা সময় পাই মাত্র চার থেকে পাঁচ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে বাস ভরে না। তখন রোডে পাড়াপাড়ি করি যাত্রী নেয়ার জন্য। কোনোদিন যাত্রী পাই, কোনোদিন পাই না। দিনশেষে সব খরচ দিয়ে মালিক কোনো কোনো দিন এক পয়সাও পায় না। ওই চাপ পরের দিন আমাদের ওপর দেন মালিক।’
ওই লোকটাও তো হয় ব্যাংক লোন নিয়া, না হয় জমি বেইচা গাড়ি কিনা রাস্তায় নামাইছে কিছু আয়ের আশায়। এহন সে যদি কিছু না পায় তাইলে তো আমারও চাকরি থাকবো না।
আব্বাসের মতে, যদি একটা বাস গাবতলী বা পাটুয়ারিতে কমপক্ষে ১০ মিনিট সময় পায় তাহলে সিটিং হিসেবে চলাচল করতে পারে। কেউ কারো সাথে পাড়াপাড়ি করবে না। চালক-মালিকের টাকা উঠে যাবে। সবাই নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাতে পারবে।
আব্বাসের মতো আরও প্রায় ১০ জন সেলফী পরিবহন শ্রমিকের অভিযোগ, এই কোম্পানির যারা নেতা আছেন তাদের বাস ১০ মিনিট পর্যন্ত সময় পায়। ওই বাসগুলো সব সিট পূর্ণ করে টার্মিনাল ছাড়ে। কিন্তু যেসব মালিকের ক্ষমতা কম, তাদের বাসগুলো টার্মিনালে যাত্রী নিতে দাঁড়াতেই পারে না। তখন তাদের রাস্তায় থাকা যাত্রী ধরতে অন্য বাসের সাথে পাড়াপাড়ি করতে হয়। সামনে থাকা বাসের আগে যেতে চালাতে হয় বেপরোয়া গতিতে। এই কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে।
এজন্য এই কোম্পানির অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেন তারা। পাশাপাশি প্রশাসনের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন, ‘টাকা খেয়ে প্রশাসন যেমন অতিরিক্ত বাস চলতে দিচ্ছে, তেমন দুর্ঘটনা হলেও বিচার না করে কোনো না কোনোভাবে পার করে দিচ্ছে।’
রুট পারমিট নেই অনেক বাসের
অর্থাৎ অনেক বাসের এই পথে চলাচলের অনুমোদন নেই। সেই সঙ্গে অনেক চালকের লাইসেন্সও নেই। শুরুতে বাস সংখ্যা কম থাকলেও টাকার বিনিময়ে কোম্পানির পরিচালকরা অতিরিক্ত বাস ব্যানারে যুক্ত করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চালক আব্বাসের প্রশ্ন, শুরুতে প্রায় শতাধিক বাস নিয়ে এই কোম্পানি যাত্রা শুরু করে। কিন্তু মাত্র দুই বছরে আরও ২০০ বাস যুক্ত হয়েছে। তাহলে হুট করে এতো চালক কোথায় পেলেন মালিকরা?
একটা ভারি লাইসেন্স পাইতে অনেক ঘুরতে হয়। অভিজ্ঞতা লাগে। আমি প্রথমে হালকা, মিডিয়াম এরপর ভারি লাইসেন্স পাইছি। আমি সাকুরা, দিগন্ত, নাবিল পরিবহনের বাস চালাইছি। এখন সেলফী চালাই। এই সেলফীতে যারা বাস চালায় কোনোদিন দেখি নাই কোচ চালাইতে। এইটা তো বড় গাড়ি। একটা ছোট গাড়ির ড্রাইভার তো মন চাইলেই এই বড় বাস চালাইতে পারবো না। কিন্তু টাকা দিয়া, প্রশাসন ম্যানেজ কইরা যারে মন চায় তারেই বাস চালাইতে দিছে।
যদিও এসব ফিটনেসবিহীন বাস এবং অদক্ষ চালকদের দায় নিতে চান না পরিবহনটির পরিচালক রফিকুল ইসলাম। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন মালিকের বাস আছে। চালকদের নিয়োগ দেন মালিকরা। ফলে অধিকাংশ চালকের তথ্য আমাদের কাছে নেই। কোনো চালক অদক্ষ হলে তার দায় মালিকের। তবে, আমি যতটুকু জানি, সবাই দক্ষ চালক। আমরাও মালিকদের ওইভাবে নির্দেশ দিয়েছি।’
বছরে চাঁদা প্রায় ১৮ কোটি টাকা
পরিবহন শ্রমিকদের হিসেবে, গাবতলী টার্মিনাল থেকে একটি বাস বের হলে দিতে হয় ১,১৫০ টাকা। আর পাটুরিয়া ঘাটে দিতে হয় ৫০০ টাকা। এছাড়া, উথুলিতে ১২০ টাকা, বরংগাইলে ৫০, বানিয়াজুরীতে ২০, মানিকগঞ্জে ৩৫০, বাথুলীতে ৫০, সাভারে ৫০, নবীনগরে ৫০ টাকা দিতে হয়। এসব টাকা তুলে থাকেন কোম্পানির নিয়োগ করা চেকাররা।
এই হিসাবে দিনে ২০০ বাস থেকে সেলফী পরিবহনের চাঁদা ওঠে ৫ লাখ টাকা। মাসে এক কোটি ৫০ লাখ, আর বছরে প্রায় ১৮ কোটি টাকা।
যদিও সেলফী পরিবহনের ফান্ডে তেমন কোনো অর্থ নেই বলে সময় সংবাদের কাছে দাবি করেছেন পরিচালক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মারা যাওয়ার ঘটনায় তারা ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। কিন্তু আমরা এতো টাকা কোথায় পাব? আমাদের তো বড় কোনো কোম্পানি না। এখানে অনেক মালিক, কিন্তু সবাই ছোট। অধিকাংশ মালিকই লোন নিয়ে গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছেন। তারমধ্যে অবরোধে আমরা একেবারে শেষ!
এসময় তাদের চাঁদার কথা তুললে তিনি শুরুতে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করেন গাবতলীতে টাকা নেয়ার কথা। বলেন, ‘৩০০ টাকা আমাদের, আর বাকি টাকা বিভিন্ন জায়গায় দিতে হয়।’ কিন্তু নবীনগরের পরে তার কোনো দায়িত্ব নেই বলে দাবি করেন। বলেন, ‘নবীনগর পর্যন্ত আমরা দেখি। এরপর কে টাকা নেয় তা আমার জানা নেই। তাদের সাথে সেলফীর কোনো সম্পর্ক নেই। ড্রাইভার-হেলপাররা মিথ্যা বলছে।’
Advertisement
সব ড্রাইভার-হেলপার কেন মিথ্যা বলবেন, তারা তো নিজেদের ভুক্তভোগী মনে করছেন, এমন প্রশ্নে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সব খোঁজ নিয়ে দেখবো।’