‘আমার ভাই বাথরুমে নিয়ে আব্বার লাশ কেটে ১০ টুকরা করেন’(ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),চট্টগ্রাম প্রতিনিধি,বুধবার, ১১ অক্টোবর ২০২৩ : চট্টগ্রামে বাবাকে খুনের পর লাশ গুমের জন্য কেটে টুকরা করা ছেলে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে দায় স্বীকার করেছেন। জবানবন্দিতে ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর দাবি করেছেন, মাকে কুফরি কালাম (তাবিজ) করা হয়েছে এমন সন্দেহে ক্ষিপ্ত হয়ে বাবাকে জীবিত অবস্থায় মুখ ও হাত-পা বেঁধে বস্তাবন্দী করে রাখেন তিনি। পরে তার অজ্ঞাতে বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাবাকে মেরে ফেলেন। এরপর মোস্তাফিজুর তার বাবার লাশ কেটে দশ টুকরা করেন, তখন বাসার বাইরে পাহারায় ছিলেন সফিকুর।

মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম সাদ্দাম হোসেনের আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

Advertisement

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক (মেট্রো) মো. ইলিয়াস খাঁন বলেন, ‘সফিকুরকে গত শুক্রবার ঢাকার হাজারীবাগ থেকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনদিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করি। রিমান্ড শেষে আজ (মঙ্গলবার) তাকে আদালতে হাজিরের পর আসামি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি নিজ বাবাকে খুন ও লাশ গুমের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।’

এর আগে পিবিআই সফিকুরের মা ছেনোয়ারা বেগম (৫০), বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান (৩২) ও স্ত্রী আনারকলিকে (২৪) গ্রেপ্তার করেছিল। তারা এখন কারাগারে আছেন।

খুনের শিকার মো. হাসান (৬১) চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নের বড়ইতলী গ্রামের সাহাব মিয়ার ছেলে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের অদূরে ১২ নম্বর গেইটে একটি ট্রলিব্যাগ পাওয়া যায়। কফি রঙের ট্রলিব্যাগে ছিল মানব শরীরের ২ হাত, ২ পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন।

এর দুদিনের মাথায় ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে নগরীর আকমল আলী সড়কের খালপাড়ে একটি খাল থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় টেপে মোড়ানো শরীরের আরেকটি খণ্ড উদ্ধার করে পিবিআই। এ ছাড়া আঙ্গুলের ছাপ ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিচয়ও নিশ্চিত করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় হাসানের স্ত্রী ছেনোয়ারা ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে। তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বাবাকে খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রায় ২৮ বছর নিখোঁজ থাকার পর দুবছর আগে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন হাসান। ফিরেই তিনি ভিটেমাটি বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এ নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে।

২০ সেপ্টেম্বর সকালে হাসান ও তার স্ত্রী, বড় ছেলে মোস্তাফিজুর নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেইট এলাকার জমির ভিলায় ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরের বাসায় ছিলেন। সেখানে বাবা ও দুই ভাইয়ের মধ্যে এ নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। এর মধ্যেই বড় ছেলে তার গলাটিপে ধরলে মারা যান হাসান। ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে দুভাই মিলে লাশ গুমের উদ্দেশে সেটি কেটে কয়েক টুকরা করে সেগুলো বিভিন্নস্থানে ফেলে দেন।

এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় বাবার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ছোট ছেলে সফিকুরের স্ত্রী আনারকলিকে। পরদিন আনারকলিকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে তিনদিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। ৩ অক্টোবর আনারকলি আদালতে জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে আনারকলি জানান, ২০ সেপ্টেম্বর সকালে নিজ বাসার একটি কক্ষে শ্বশুর হাসানকে তার ভাসুর মোস্তাফিজুর ও স্বামী সফিকুর মিলে একটি বস্তায় ভরতে দেখেন। তবে জীবিত নাকি মৃত সেটা বুঝতে পারেননি। বিকেলে আনারকলি জানতে পারেন, তার শ্বশুরকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভাসুর ও স্বামী হাসানের লাশ কেটে কয়েক টুকরা করেন। লাশের ‍টুকরোগুলো লাগেজ, ব্যাগ ও বস্তায় ভরেন তারা। রাতে একজন অজ্ঞাত লোকের মাধ্যমে তারা একটি বস্তা বাইরে ফেলে দেন।

পরদিন সকালে লাগেজ ও স্কুলব্যাগ নিয়ে স্বামী ও ভাসুরের সঙ্গে বের হন আনারকলি। লাগেজ নিয়ে ফেলেন পতেঙ্গার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায়। স্কুলব্যাগে ছিল খণ্ডিত মাথা, সেটা নিয়ে আনারকলি ও সফিকুর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যান। মাথাসহ ব্যাগ পাথরের ব্লকের ভেতরে ফেলে দিতে চাইলে আনারকলি ব্যাগ রেখে দেন। এরপর সফিকুর শুধু খণ্ডিত মাথাটি পাথরের ব্লকের ভেতর ফেলে দেন।

৬ অক্টোবর সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরকে (২৯) ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পিবিআই জানিয়েছে, বাবাকে খুনের পর পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে নাম-পরিচয় গোপন করে ট্যানারিতে চাকরি নিয়েছিল সফিকুর। গ্রেপ্তারের পর তাকে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে খণ্ডিত মাথার সন্ধানে তল্লাশি চালানো হয়, তবে সেটি পাওয়া যায়নি।

জবানবন্দিতে কি বলেছেন সফিকুর ?

জবানবন্দির শুরুতে তার মা, বড় ভাই, বোন এবং নিজের স্ত্রীসহ পরিবারের বর্ণনা দেন। বাবা হাসান ২৭ বছর নিখোঁজ ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাবার সঙ্গে আমার পরিচয়ও ছিল না। ২৭ বছর পর ফিরে এসে তিনি আমার চাচাদের সঙ্গে মিলে আমাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। আমরা বাধা দিলে বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার মাকে বিভিন্ন ধরনের কুফরি কালাম (তাবিজ) করেন। এতে আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন।’

Advertisement

‘ঘটনার মাসখানেক আগে আমার মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য আমার বর্তমান ঠিকানার ভাড়া বাসায় নিয়ে আসি। এর মাসখানেক আগে আমার আব্বা বাঁশাখালীতে আমাদের বাড়িতে আসেন। আব্বা গত রোজার ঈদের সময় আমাদের বলেন- আমার কোনো ছেলে নেই, তোর আম্মাকেও আমি চিনি না। এসব কথাবার্তার জন্য আমি বাবার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলাম। একবার আমি আব্বাকে গ্রামে আমাদের ঘরে ঢুকতে নিষেধ করি এবং আম্মাকেও বলি যেন ঘরে ঢুকতে না দেন। পরে গ্রামের ইউপি মেম্বার সেটা মীমাংসা করে দেন।’

২৭ বছর পর ফেরার পরও মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যাবার তথ্য দিয়ে সফিকুর জানান, তার বাবা ফিরে এলে তার মা অসুস্থ হয়ে যেতেন। এতে তাদের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় যে, তার বাবা তাদের মাকে কুফরি কালাম করেছেন। হত্যাকাণ্ডের মাসখানেক আগে তার মাকে চিকিৎসার জন্য বাসায় নিয়ে আসার পর তার বাবা বারবার তাকেও বাসায় নেয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। একপর্যায়ে রাজি হন সফিকুর।

‘ঘটনার আগের দিন রাতে আনুমানিক ১০টা থেকে ১১টার দিকে আব্বা ব্যাগে কিছু ফলমূল, একটি বডি স্প্রে ও কিছু তাবিজ নিয়ে আমার বাসায় আসেন। ঘণ্টা খানেক পর আমার ভাইও আমার বাসায় আসেন। রাতে আমরা ভাত খেয়ে যে যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি ও আমার ভাই একরুমে গিয়ে আব্বার সঙ্গে কথা বলি।’

জবানবন্দিতে সফিকুর হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আব্বাকে আমি বলি যে, আপনি আমার মাকে কুফরি কালাম করেছেন, আমার মা সুস্থ না হলে আমি আপনাকে ছাড়বো না। তখন আব্বা বলেন-তোর আম্মা বেশিদিন বাঁচবে না, মরলে মরুক। আমি তার কাছে কুফরি কালাম করার ঠিকানা জানতে চাই। বারবার বলার পরও না দেয়ায় আমি ক্ষিপ্ত হয়ে গামছা দিয়ে আব্বার মুখ বেঁধে এবং রশি দিয়ে হাত ও পা বেঁধে একটি বস্তায় ঢুকিয়ে রাখি।’

‘এরপর আমি বাইরে চলে যাই। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর আমার ভাই আমাকে কাঁপতে কাঁপতে বলে- আমি আব্বাকে মেরে ফেলেছি। আমি তখন রুমে গিয়ে বস্তার মুখ বাঁধা অবস্থায় দেখি। তখন আমি আমার রুমে গিয়ে কলিকে (স্ত্রী) ডাকি। তার সঙ্গে লাশ গুম করার পরামর্শ করি। বাবাকে মারার বিষয় জানার পরেই আমার ভগ্নীপতিকে ডেকে তার সঙ্গে সিএনজিতে করে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিই।’

লাশ গুমের বর্ণনা দিয়ে সফিকুর বলেন, ‘আমি বাসার বাইরে পাহারা দিচ্ছিলাম। আমার ভাই বাথরুমে আব্বার লাশ নিয়ে কেটে ১০ টুকরা করেন। রাত ২টার দিকে আমি রাস্তা থেকে একটা টোকাই ছেলেকে ধরে এনে তাকে দিয়ে বাবার শরীরের অংশ আকমল আলী খালে ফেলে দিই। তাকে ৫০০ টাকা দিই। পরদিন সকালে কলি ও আমার ভাইকে লাগেজে করে শরীরের বাকি অংশ নিয়ে একটি রিকশায় করে সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় পাঠায়। তারা সেখানে গেলে আমি একটি অটোরিকশা ভাড়া করি।’

‘অটোরিকশায় উঠে আমরা তিনজন পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাটের কাছে গিয়ে লাগেজ সেখানে ফেলে দিই। সেখান থেকে আবার বাসায় যাই। বাসায় একটি স্কুলব্যাগের মধ্যে মাথা রাখা ছিল। আমি ও কলি সিএনজিতে করে সেটি নিয়ে পতেঙ্গা বিচে যাই। দুজন সাগরে নেমে পাথরের ব্লকের ফাঁকে ব্যাগ থেকে মাথাটি ফেলে দিই।’

Advertisement

বাবাকে যে বাসায় হত্যা করা হয়েছে, সেই বাসায় ঘটনার পর আরও দু’দিন থাকার তথ্য দিয়ে সফিকুর বলেন, ‘দুদিন পর আমি ও কলি নোয়াখালী চলে যাই। সেখান থেকে ভোলা যাই। ভোলা থেকে কলিকে মহেশখালীতে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। আমি ভোলা থেকে ঢাকা চলে যাই। ঢাকা থেকে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে।’