ভাসমান অপরাধীদের ‘সদরদপ্তর’ বছিলা (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা (মোহাম্মদপুর) প্রতিনিধি ,সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩ : রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলা গার্ডেন সিটি হাউজিংয়ের একপাশে তুরাগ নদ, আরেক পাশে ঢাকা চন্দ্রিমা উদ্যান। ফলে সন্ধ্যা নামলেই পুরো এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। নদের পাশেই রয়েছে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ। তবে ছিনতাই আতঙ্কে অনেকেই সেখানে হাঁটাহাঁটি করতে  ভয় পান। বছিলা গার্ডেন সিটির আশপাশে নিম্ন আয়ের লোকজনই বেশি বসবাস করেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, পুরো এলাকা কার্যত ভাসমান অপরাধীদের সদরদপ্তর হয়ে উঠেছে। নদের ওপারের আটিবাজার থেকেই অনেকে এসে বছিলায় অপকর্ম করে আবার দ্রুত পালিয়ে যায়।

Advertisement

সর্বশেষ গত শুক্রবার বছিলায় দুটি কিশোর গ্যাং মুখোমুখি অবস্থান নেয়। তারা দেশি অস্ত্রসহ মহড়া দিয়েছে। এর মধ্যে একটি গ্রুপের সদস্যরা মহড়ার সময় গণছিনতাই চালায়। কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে  তারা লুট করে। এ সময় তাদের হামলায় বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ আহত হন।  আহতদের মধ্য চারজন এখন পর্যন্ত পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তাদের মহড়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে  ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এ ঘটনায় জড়িত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে– মো. আকাশ (লেগুনাচালক), মো. নয়ন (ফুটপাতে গেঞ্জি বিক্রেতা), সজল ইসলাম (ডানোর ভ্যানগাড়ি চালক), আবু কালাম (বাসের হেলপার), আরিফ (অটোরিকশাচালক), সজীব (গার্মেন্ট শ্রমিক), কবির (রংমিস্ত্রি), নাসির (রাজমিস্ত্রি) ও মো. সুজন (লেগুনাচালক)। তাদের দলনেতা আরিফ। তিনি অটোরিকশাচালক। মূলত নির্মাণ শ্রমিক, লেগুনাচালক-হেলপারসহ নানা পেশার বখাটে কিশোর-তরুণরা মিলে গ্রুপ তৈরি করে অপরাধে জড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিজেরাও জড়াচ্ছে বিবাদে। এ ছাড়া শুক্রবারের ঘটনায় জড়িত আরও অন্তত ২০ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ ও র‌্যাব।

ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মৃত্যুঞ্জয়  দে সজল বলেন, বছিলায় অপরাধে জড়িতদের অধিকাংশই ভাসমান। ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে।

স্থানীয়রা বলছেন, বছিলায় প্রায়ই চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায়ও গ্যাং সদস্যরা সম্পৃক্ত হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, অন্তত তিনটি গ্রুপ সেখানে সক্রিয়। সন্ধ্যার পর মোটরসাইকেল ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মহড়া দেয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় তিনটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, তাদের দিয়ে ওই এলাকায় জমি দখল থেকে শুরু করে অটোরিকশা থেকে চাঁদা তোলা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সম্প্রতি ‘রক্তচোষা জনি’ নামে দুর্ধর্ষ এক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা রয়েছে।

শুক্রবারের ঘটনায় অংশ নেয় ৩৫ থেকে ৪০ কিশোর। তাদের বয়স ১৩ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। সবার হাতে দেশি অস্ত্র ও লাঠি ছিল। তারা বছিলা গার্ডেন সিটি হাউজিংয়ের বি ব্লকের মুখে জড়ো হয়। পরে মোল্লা মসজিদ পার হয়ে হামলা ও ছিনতাই শুরু করে। সেখান থেকে এইচ ব্লকের শেষ ওয়াকওয়ে পর্যন্ত দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এ ছাড়া তারা রাস্তায় থাকা পথচারীদের কাছ থেকেও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে। কেউ মোবাইল ও মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে অস্বীকার করলে তাদের ওপর হামলা করেছে। হামলার নেতৃত্ব দেয় আকাশ নামে এক তরুণ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কিছু ব্যক্তি এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দেয়। এই চক্রের সদস্যদের তারা হাউজিং এলাকার জমি দখল, লেগুনা ও অটোরিকশা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগায়। তিনি জানান, শুক্রবারের ঘটনায় অধিকাংশ এখন এলাকাছাড়া।

গতকাল রোববার বছিলা গার্ডেন সিটি হাউজিং, ঢাকা চন্দ্রিমা উদ্যানসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব গোষ্ঠীর সহিংস তৎপরতার তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া তাদের তাণ্ডবের চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে বিভিন্ন দোকানের শাটার ও দেয়ালে। শুক্রবার তাদের দেখে অনেকে দোকানের শাটার বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন। গ্যাং সদস্যরা সেসব দোকানের শাটারে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছে। ইটপাটকেল ছুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছে।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা চন্দ্রিমা উদ্যানের বটতলী রোডের মুখে তুরাগ নদের পাড়ে দেখা যায়,  বেশ কিছু কিশোর আড্ডা দিচ্ছে। আশপাশের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব কিশোর সন্ধ্যার পর ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সেখানে নিয়মিত মাদক সেবন থেকে শুরু করে মারামারিতে লিপ্ত হয় তারা।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, শুক্রবার হাউজিং এলাকা থেকে একটি গ্রুপ অপর একটি গ্রুপের ওপর হামলা করে। এ সময় তারা যাওয়ার পথে ছিনতাই ও লুটপাট করে। তাদের একটি গ্রুপ হামলা করতে ঢাকা চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায় গিয়েছিল। সেখানে টার্গেট ব্যক্তিদের না পাওয়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি।

Advertisement

গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় তারা ওই এলাকার রাস্তার পাশের ১৫-২০টি দোকানে লুটপাট ও ভাঙচুর চালিয়েছে। ওই ঘটনা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট কাজ করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বি-এইচ ব্লক পর্যন্ত লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা অপরিচিত কারোর সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে। এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ১০ তলা একটি বহুতল ভবনের নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তোফাজ্জল হোসেন। তিনি জানান, ওই নির্মাণাধীন ভবনেই থাকেন তারা। শুক্রবার সন্ধ্যার পর ওই ভবনের সামনেই মায়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিলেন। আকস্মিকভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কিশোররা তাঁকে ঘিরে ধরে। মোবাইল ফোন দিতে বলে। তিনি দিতে না চাওয়ায় তাঁকে বেদম মারধর করে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। পরে তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করে পাশের একটি ফার্মেসিতে নিয়ে চিকিৎসা করান।

সেদিনের সহিংসতায় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফ্রেশ ফুড কর্নারের মালিক হাবিবুর রহমানের। অন্য দোকানে বাইরে থেকে জিনিসপত্র নিলেও তাঁর দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর করেছে তারা। পুরো ব্লকের শুধু দুটি দোকান অক্ষত রয়েছে।

হাবিবুর রহমান বলেন, নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করি। তবে রাত ১২টার দিকে পুলিশ আসে। পুলিশ অনেক বিলম্বে এসেছিল।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে প্রতি সপ্তাহে ছিনতাইয়ের দু-একটি ঘটনা ঘটে। কয়েক দিন আগেও পাঁচ-ছয়জন যুবক এসে নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিকদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে। তারা মূলত মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়ার সময় ছিনতাই ও হামলা চালায়। এ ছাড়া সারারাত এই এলাকায় মোটরসাইকেলে শোডাউন এবং হৈহুল্লোড় করে। কারও প্রতিবাদ করার সাহস হয় না। কয়েকজন দোকানদার তাদের সোর্স হয়েও কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে ওয়াকওয়েতে হাঁটতে গিয়ে নুসরাত আফরিন নামে এক নারী ছিনতাইকারীদের হাতে হামলার শিকার হন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ বেশ কয়েকজন কিশোর এসে গলায় অস্ত্র ধরে বলে, মোবাইল ফোন আর টাকা দিতে। পরে একজন আমার ব্যাগ খুলে মোবাইল নিয়ে নেয়। অন্যরা অনেক আঘাত করে। মোবাইল নিয়ে যাওয়ার পর ছিনতাইকারীদের একজন এসে আমাকে সেটের লক খুলে দেওয়ার হুমকি দেয়। লক খুলতে দেরি হওয়ার কোপ মারা শুরু করে। ওই অবস্থায় আমি দৌড়ে পালাই।’

বি-এইচ ব্লক নির্মাণাধীন একটি ভবনের শ্রমিক মো. রাসেলকেও মোবাইল না দেওয়ায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। তিনি বলেন, জীবনে এই প্রথম চোখের সামনে ছিনতাইকারীদের এমন ভয়াবহ রূপ দেখলাম। আমি তখন দোকানে চা খেতে বের হয়েছিলাম। এ সময় এক দল কিশোর অস্ত্র নিয়ে সেখানে হামলা করে। তারা আমার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়।

Advertisement

ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) আজিজুল হক বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আটক কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তারে কয়েকটি টিম কাজ করছে।