স্বপ্নের দেশ আমেরিকার অন্ধকার জগত (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি,শনিবার, ২২ জুলাই ২০২৩ : স্বপ্নের দেশ’ আমেরিকা। যে নামটি শুনলে সবার চোখে ভেসে ওঠে আলো ঝলমলে সব শহর। নিউইয়র্ক, লাস ভেগাস, লস অ্যাঞ্জেলেস, ওয়াশিংটন ডিসি। অনেকের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও শান্তিময় দেশ যুক্তরাষ্ট্র। স্বপ্ন দেখেন, সেখানে বসবাসের।

কেউ মনে করতে পারেন, স্বপ্নের এই দেশটির সবাই খুবই সুখী; কোনো গরীব নেই, সবাই ধনী, বাড়িগাড়ির মালিক। অপরাধ, হানাহানি, মারামারি; আমেরিকাতে এসব কিছুই নেই।

Advertisement


কিন্তু আলোর নিচেই যেমন অন্ধকার। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও ঠিক তেমনি। স্বপ্নের দেশেও রয়েছে অন্ধকার এক জগত। যে জগতের বেশিরভাগই দরিদ্র, অপরাধ ও মাদকের দখলে।
দরিদ্রের কথাই যদি ধরি, সবশেষ হালনাগাদ এক মার্কিন পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি। তাদের মধ্যে প্রায় দুই কোটি মানুষ রয়েছে চরম দারিদ্র্যের কবলে।

এছাড়া দেশটিকে অপরাধ জগতের স্বর্গরাজ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। মাদক, সন্ত্রাস কোনো দিক থেকেই পিছিয়ে নেই যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে প্রতিদিনই ঘটছে বন্দুক হামলার ঘটনা, আর এতে প্রাণ ঝরছে অসংখ্য মানুষের।

দেশটির সবচেয়ে পরিচিত সামাজিক সমস্যা বর্ণবাদ। সাধারণ মানুষ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবার মাঝেই রয়েছে বর্ণবাদী আচরণ। আর প্রতি বছরই এই বর্ণবাদ সহিংসতায় প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ।

তবে দেশটিতে সবচেয়ে ব্যাপকহারে বেড়েছে মাদকের ব্যবহার। নতুন নতুন মাদকের নেশায় বুঁদ দেশটির তরুণ-যুবারা। আর অতিরিক্ত মাদক সেবনে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
 

দারিদ্র্য

যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশটিতে মোট দারিদ্র্যের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। যা মোট জনসংখ্যার ১১.৬ শতাংশ। জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে প্রথম স্থানে থাকা সত্ত্বেও এমন অবস্থা।


বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, দৈনিক মাত্র এক দশমিক ৯০ ডলারে জীবনযাপন করছেন যুক্তরাষ্ট্রে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২০০ টাকা। ২০০ টাকায় বাংলাদেশের সংসার চালানো যেখানে অসম্ভব সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে তো অকল্পনীয়।

বাংলাদেশে যেমন রাস্তার পাশে অসংখ্য হতদরিদ্র মানুষ দেখা যায়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাস্তায়ও দেখা মেলে হতদরিদ্র মানুষের। যাদের বাসস্থান নেই, রাস্তার রাস্তায় জীবন কাটাতে হয়। শুধু হতদরিদ্র নয়, দেখা মেলে ভিক্ষুকেরও।

মুভ ফর হাংগার নামে আমেরিকান এক ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। যার মধ্যে প্রতি আটজনে একজন শিশু।
দেশটিতে বর্তমানে ৪০০- এর অধিক খাদ্য সহায়তাকারী সংগঠন আছে, যারা অনাহারীদের খাবার সরবরাহ করে থাকেন। যদিও তা দিয়ে পুরো আমেরিকার ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব না।

কায়রোস সেন্টার ফর রিলিজিয়নস রাইটস অ্যান্ড সোশ্যাল জাস্টিসের পলিসি ডিরেক্টর শৈলি গুপ্তা বার্নস বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। ফলে মাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধও বেড়ে গেছে।’

এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর দেশটিতে দারিদ্র্যের হতাশা থেকে অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যা করেন। অনেকে জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধ, অপকর্মের সঙ্গে। যেমন মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে, ভাড়ায় মানুষ খুন করে থাকেন।
 

মাদক

যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি সবচেয়ে ব্যাপকহারে বেড়েছে মাদকের ব্যবহার। এমন কোনো মাদক নেই, যা যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায় না। হাত বাড়ালেই মেলে কোকেন, হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবা ও এলএসডিসহ সব ধরনের মাদক। সম্প্রতি দেশটিতে আরও একটি মাদক ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাণঘাতী সিনথেটিক এই মাদকের নাম ফেন্টানিল। যা হেরোইনের চেয়ে ৫০ গুণ আর মরফিনের তুলনায় শতগুণ বেশি শক্তিশালী।


যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় মাদক অপব্যবহার ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, অতিরিক্ত মাদক গ্রহণে দেশটিতে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতি ঘণ্টায় এ সংখ্যা ১১।

সম্প্রতি সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদক গ্রহণের কারণে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দিনদিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চলতি বছর এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারেও বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

মার্কিন ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ব্যক্তিরাই অতিরিক্ত মাদক সেবন করে থাকেন। এছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিপুল পরিমাণে মাদক সেবন করে থাকেন।
সিএনএনের এক প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের প্রথম মাসেই ওয়াশিংটন ডিসির বিভিন্ন স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ফেন্টানিলের ওভারডোজের কারণে মারা গেছে। যাদের সবার বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর।

এছাড়াও প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রের পথেঘাটে অসংখ্য যুবককে মাদক সেবন করে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারা শুধু নিম্ন শ্রেণির পরিবারের সদস্য নয়, অনেক ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়েকেও দেখা যায়।

গত বছর বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৫ কোটি ৬০ লাখ ফেন্টানিল ট্যাবলেট জব্দ করা হয়। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১০ হাজার পাউন্ড ফেন্টানিল পাউডার জব্দ করে, যা দিয়ে ৩৭ কোটি ৯০ লাখ ট্যাবলেট বানানো সম্ভব। জব্দ হওয়া এই ফেন্টানিল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব নাগরিককে হত্যা করা সম্ভব বলে মনে করে দেশটির মাদকবিষয়ক প্রশাসন ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিইএ)।
 

বন্দুক সহিংসতা

একের পর এক বন্দুক হামলায় বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। বন্দুক হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, গির্জা ও শপিংমল। আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, দেশটিতে গড়ে প্রতি ৫ সেকেন্ডে একটি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হয়, প্রতি ১৪ মিনিটে সেই আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে একটি প্রাণ যায়।


বিশ্বের মোট হ্যান্ডগানের তিনভাগের এক ভাগই মার্কিনিদের হাতে। বাংলাদেশে যেমন লবণ কেনা সহজ, তেমনি আমেরিকাতে হ্যান্ডগান কেনাও সহজ। সেগুলো তারা খেয়াল খুশি মতো ব্যবহারও করে।

বন্দুক সহিংসতা আর্কাইভ অনুসারে, গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতায় ৪৪ হাজার ৩১০ জন মারা গেছেন। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে দেশটিতে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ বন্দুক সহিংসতায় মারা যান। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৪৯১ জন কিশোর ও ৮৫ জন শিশু। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১৫ জন মারা যাচ্ছেন।

মানুষের চেয়ে যদি কোনো দেশে বন্দুকের সংখ্যা বেশি থাকে, সেখানে এই ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা বেশিই থাকে। যুক্তরাষ্ট্রেও তাই ঘটছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা স্মল আর্মস সার্ভের (এসএএস) হিসাবে, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যেখানে জনসংখ্যার চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুকের সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে ১২০টি করে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে বন্দুকের সহিংসতার পরিসংখ্যানে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এসএএসের গবেষকদের হিসাবে বিশ্বজুড়ে ৮৫ কোটি ৭০ লাখ বেসামরিক আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুক রয়েছে। এরমধ্যে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ বা ৪৪ শতাংশের মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের হাতে।

ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। এই মৃত্যুর হার পরের অবস্থানে থাকা কানাডার চেয়ে ৮ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে ২২ শতাংশ ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি।

সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বের ৪ শতাংশ মানুষের বাস যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৯ সালে বিশ্বে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আত্মহত্যার ৪৪ শতাংশই সংঘটিত হয়েছিল দেশটিতে। ওই বছর ২৩ হাজার আমেরিকান গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
 

বর্ণবাদ

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাতে ধর্ম আর বর্ণ কি, দিন শেষে সবাই মানুষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রে শরীরের বর্ণের ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করে। দেশটিতে গায়ের রং নিয়ে বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।


পরিবার-স্কুল-কলেজ-কর্মজীবনে সর্বত্র শরীরের বর্ণ নিয়ে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়। সাধারণ মানুষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবার মধ্যেই রয়েছে বর্ণবাদী আচরণ। বর্ণবাদ এমন একটি বৈষম্যমূলক আচরণ, যা মানুষের মধ্যে বিভাজন ও পার্থক্য তৈরি করে।

যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণ সম্পর্ক গত ২০ বছরের হিসাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। গাত্রবর্ণের কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্য নিয়ে একবিংশ শতাব্দীর এ সময়েও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার।

এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, বর্ণ সম্পর্ক এখন নাজুক অবস্থায়। ৫৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মনে করেন, শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সম্পর্ক এখন খারাপ।

অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে, যুগ যুগ ধরে অবজ্ঞা, অবহেলা আর সুযোগের অভাবই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের একটা বড় অংশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে দেশটির অনেক শ্বেতাঙ্গ নিজেদের ভাবছেন অনিরাপদ। আর সেই অনিরাপত্তা থেকেই জন্ম নিচ্ছে ঘৃণার।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নাগরিকের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে দুটি নীতি অনুসরণ করে। একটি আচরণ নীতি সাদাদের জন্য, একটি কালোদের জন্য। এই দুটি নীতি সহজাতভাবেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও বৈষম্যপূর্ণ।
এই দেশে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের পীড়নমূলক আচরণ এখন যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। গত বছরে জুন মাসে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের আকরন শহরে একদল পুলিশ জেল্যান্ড ওয়াকার নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির পিঠ ৪৬টি বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে ফেলে। একটি ছোটখাটো ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওয়াকারকে এভাবে পুলিশ গুলি করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশিংয়ের মারাত্মক বর্ণবাদী বাস্তবতা এবং পুলিশের হাতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে কালোদের প্রাণ হারানোর ঘটনার সমর্থনে আমেরিকান নেতৃত্বের দৃঢ় অবস্থান সত্যিই শ্বাসরোধকর হয়ে উঠছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালে পুলিশের গুলিতে এক হাজার ১৪ জন মারা গেছেন। যাদের মধ্যে অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চালানো জরিপ মতে, আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যায় কৃষ্ণাঙ্গরা।

এছাড়াও দেশটিতে রয়েছে ঘৃণাজনিত অপরাধ। চলতি বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনসের প্রকাশিত উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে দেশটিতে ঘৃণা ও বিদ্বেষজনিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৬৫টি। এটি ২০২০ সালের তুলনায় ১১ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

এসব অপরাধের ভুক্তভোগীদের ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশই জাতিগত বা বংশগত পক্ষপাতিত্বের কারণে হামলার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ ও ১৪ দশমিক এক শতাংশ মানুষ তাদের লিঙ্গ পরিচয় বা ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের কারণে হামলার শিকার হয়েছে।

ঘৃণা ও বিদ্বেষজনিত অপরাধের মধ্যে ৪৩ দশমিক এক শতাংশ ছিল ভীতি প্রদর্শন, ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল সাধারণ আক্রমণ এবং ২০ দশমিক এক শতাংশ ছিল গুরুতর আক্রমণ।

Advertisement

ধর্ষণ

মেয়েদের জন্য বাংলাদেশ নাকি যুক্তরাষ্ট্র বেশি অনিরাপদ? কোনো পরিসংখ্যান না জেনেই অনেকে হয়তো বলবেন, বাংলাদেশে নারীরা অনিরাপদ, যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা নিরাপদ। তাহলে আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল! পরিসংখ্যান দেখলেই তা স্পষ্ট হবে।


জাতিসংঘ প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ক্রাইম ট্রেন্ড রিপোর্ট বলছে, প্রতিবছর সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে। ১০টি দেশের তালিকায় এক নম্বর অবস্থান আছে দেশটি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। এ তালিকায় ১০ নম্বরেও নেই বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিক অনুযায়ী, দেশটিতে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিসংখ্যান ৯১ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ পুরুষ। ন্যাশনাল ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইম্যানের সার্ভে অনুযায়ী আমেরিকার প্রতি ৬ জন নারীর মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার।

পুরুষদের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটা ৩৩ জনে একজন। এই দেশে ১৪ বছর বয়স থেকেই শিশুদের মনে ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রবণতা তৈরি হয়। আর ৯৯ শতাংশ ধর্ষক হচ্ছে পুরুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২৫ শতাংশ নারী রিপোর্ট করেছে যে, তাদেরকে ১৪ বছর বয়সের আগেই ধর্ষণ করা হয়েছে অথবা ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন। তবে সব ঘটনার মাত্র ১৬ শতাংশ রেকর্ড করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে ভিকটিমদের ঘর-বাড়িতেই।

জাতিসংঘের সরবরাহকৃত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্রাজিলে এর হার প্রতি লাখে ২১ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং ভারতে এক দশমিক ৮ শতাংশ।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র বা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল তথা সিডিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ নারী যৌন নিপীড়ন বা যৌন হয়রানির শিকার। স্বামী বা স্বজনের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২৫ শতাংশ নারী। প্রতি চারজন নারীর একজন একাধিকবার নিকটজনের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। মিনিটে অন্তত ২৪ জন ধর্ষণ, যৌন হয়রানি অথবা শারীরিক অত্যাচারের শিকার হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব নারীর ৮০ শতাংশই ২৫ বছর বয়সের আগেই ধর্ষিত হয়। আর অর্ধেকেরও বেশি নারী বর্তমান বা সাবেক সঙ্গীর ধর্ষণের শিকার হয়। প্রতি আটজনে একজন নারী পরিবারের সদস্যদেরই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।  

৩৫ ভাগ নারী ১৮ বছরের আগেই ধর্ষণের শিকার হয়। অন্যদিকে প্রতি সাতজনে একজন পুরুষ শারীরিক নির্যাতনের শিকার এবং ৭১ জনের মধ্যে একজন পুরুষ ধর্ষিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
 

গণহত্যা

গণহত্যাতেও এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। গণহত্যা হলো সেই হত্যাকাণ্ড, যখন কোনো একটা ঘটনায় চার বা তার অধিক সংখ্যক মানুষ মারা যায় এবং হত্যাকাণ্ডের মাঝে কোনো বিরতি থাকে না। গণহত্যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে, যেখানে এক বা একাধিক মানুষ অন্যদের মেরে ফেলে।


গণহত্যা নিয়ে ২০১৯ সালে যৌথভাবে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে অ্যাসোসিয়েট প্রেস ও ইউএসএ টুডে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, যেকোনো বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি ম্যাস কিলিং বা গণহারে হত্যার ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ওই বছর দেশটিতে মোট ৪১টি গণহারে হত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে যাতে প্রাণ হারিয়েছে মোট ২১১ জন।

২০১৯ সালের ৪১টি ঘটনার মধ্যে ৩৩টিতে আগ্নেয়াস্ত্র জড়িত ছিল বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। রাজ্যভিত্তিক দেখলে সবচেয়ে বেশি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। মোট আটটি ঘটনা ঘটেছে সেখানে।

২০০৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গণহারে হত্যার ঘটনা পর্যায়ক্রমে শনাক্ত করে এই তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে। তবে ১৯৭০-এর দশকের কোনো গবেষণাতেও এতো বেশি গণহারে হত্যার ঘটনা সংবলিত কোনো বছরের উল্লেখ পাওয়া যায়নি, বলছে এপির প্রতিবেদন।
তবে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটলেও এ ধরণের হামলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে ২১১ জন মারা গেলেও ওই বছর বিভিন্ন ঘটনায় ২২৪ জন মানুষ মারা যায়। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে গুলির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছিল।

২০১৭ সালে লাস ভেগাসে একটি উৎসবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল ৫৯ জনকে। গবেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক গণহারে হত্যার ঘটনা সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয় না। কারণ ওই সব ঘটনায় পারিবারিক দ্বন্দ্ব, মাদক ব্যবসা বা গ্যাং সহিংসতা জড়িত থাকে এবং এগুলো জনসমক্ষে ঘটে না। এজন্য অনেক গণহত্যা থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে।

Advertisement


মার্কিন সমাজে যে মরিচা পড়েছে সেটি সাধারণ মানের চেষ্টায় পরিষ্কার করা যাবে না। একটা বড় ধরনের ঘষামাজা সেখানে দরকার। কিন্তু আমেরিকানরা অন্যকে নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত যে নিজেদের ঘর গোছাতে তারা সময় করে উঠতে পারছে না।