ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শুক্রবার, ২১ জুলাই ২০২৩ :পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর টনক নড়লো যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটিতে বাংলাদেশি এক শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় অবশেষে সমবেদনা জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। অথচ এর আগে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দেশটি। এবারই প্রথম এমন শোক জানিয়েছে দেশটির দূতাবাস।
Advertisement
বুধবার (১৯ জুলাই) ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার পর গত মঙ্গলবার উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৩ দূতাবাস ও হাইকমিশন। এর প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আমেরিকায় যখন-তখন লোক মেরে ফেলে। তারা কি কখনও বিবৃতি দেয়? ইউএন কি কোনোদিন বিবৃতি দিয়েছে? বলেছে যে আমেরিকায় লোক মরে যায় কেন?
‘ক্যামব্রিজে একটি বাঙালি ছেলে মারা গেল ফয়সাল, তারা কি বলেছে যে ছেলের তদন্ত কতদূর হয়েছে। কিংবা রাষ্ট্রদূতরা কি দল বেঁধে কোনো বিবৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ হলেই হইছে, একটা মগের মুল্লুক পাইছে ওরা,’ যোগ করেন তিনি।
এদিকে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি (আরসি) গোয়েন লুইস টুইট করেছিলেন। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়কারী শেলডন ইয়েটকে তলব করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়।
টনক নড়লো যুক্তরাষ্ট্রের
বিশ্বজুড়ে ‘মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা’ যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা নৈমিত্তিক ঘটনা। দেশটিতে বাংলাদেশিদের এমন মৃত্যুর খবরও আসছে প্রায়ই। এ বছরই ২ জন বাংলাদেশি বন্দুক হামলায় নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের নাম আরিফ সাঈদ ফয়সাল (২০)। যিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস অব আমহার্স্টের ছাত্র ছিলেন। আরেকজন রমিম উদ্দিন আহম্মেদ (২২)। এর আগে ২০২১ সালে মোয়াজ্জেম হোসেন সাজু (২৮) নামে একজন নিহত হন।
এসব ঘটনার পর আজ যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রমিমকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজ থেকে সমবেদনা জানিয়ে পোস্ট দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, ‘মিসৌরিতে ডাকাতির ঘটনায় নিহত বাংলাদেশি ছাত্রের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমরা আশা করি, এই ধরনের ঘৃণিত অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ।’
মার্কিন পুলিশ মারছে সাধারণ মানুষ
মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি নিয়ে বিশ্বজুড়েই বিতর্ক রয়েছে। এর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটি। একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার ওপর প্রায়ই দিয়ে থাকে তারা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হত্যাকাণ্ডের তথ্য রীতিমতো চমকে ওঠার মতো।
Advertisement
পুলিশি হত্যাকাণ্ডের খোঁজখবর ও তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করে এমন একটি ওয়েবসাইট ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স। এই ওয়েবসাইটের বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ২০২২ সালে ১ হাজার ১১৭ জনকে হত্যা করেছে। যা ২০১৩ সালের পর এক বছরে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের রেকর্ড। এই হিসেবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে দিনে গড়ে ৩ জনেরও বেশি মানুষ পুলিশের গুলিতে মরেছে।
ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স ২০১৩ সাল থেকেই রেকর্ড রাখা শুরু করে। সেই থেকে প্রতিবছরই দেশটিতে পুলিশের হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালে পুলিশ ১ হাজার ১৪৫ জনকে হত্যা করেছে। ২০২০ সালে ১ হাজার ১৫২জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৯৭ জন, ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৪০ জন আর ২০১৭ সালে ১ হাজার ৮৯ জন প্রাণ হারান।
আর ওয়েবসাইটটির পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত পুলিশের হাতে ৬০২ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে মার্কিন পুলিশ। এর প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামেন দেশটির লাখো জনতা। এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা দেশটিতে বিদ্যমান জাতিগত বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু আরও একবার খোলাখুলিভাবে সামনে নিয়ে আসে।
‘বিচারক এবং জল্লাদ হওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতাকে অন্য স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা যতই জোর দিই যে এটি ভুল, সমাজ এটি ঘটতে দেয়া যায় না।’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে বলছিলেন জ্যাকব ব্লেক সিনিয়র নামে এক মার্কিনি। যার ছেলে কেনোশা ২০২০ সালে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার পর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিবৃতি, মন্ত্রণালয়ের অসন্তোষ
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে বিবৃতি দেয়ায় জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়কারী শেলডন ইয়েটকে তলব করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শেলডন ইয়েটকে তলব করা হয়। ভবিষ্যতে ঢাকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘ যেন প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে, এমন প্রত্যাশাও জানানো হয়।
এরআগে, বুধবার (১৯ জুলাই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিভিন্ন দূতাবাস ও জাতিসংঘের বিবৃতি বিষয়ে অসন্তোষ জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অ্যাকটিভিস্ট কূটনীতিকদের বলতে চাই- আমেরিকাতে যখন-তখন লোক মেরে ফেলে। তারা কি কখনো বিবৃতি দেয়? জাতিসংঘ কি কোনো দিন বিবৃতি দিয়েছে? বলেছে যে আমেরিকাতে লোক মরে যায় কেন? ক্যামব্রিজে ফয়সাল নামের একটি বাংলাদেশি ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, তারা কি বলেছে ছেলের তদন্ত কতদূর হয়েছে? কিংবা রাষ্ট্রদূতরা কি দল বেঁধে কোনো বিবৃতি দিয়েছে? তাদের জিজ্ঞেস করেন না কেন?’
বাংলাদেশ ইস্যুতেই সরব সবাই
বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা যেসব তৎপরতা চালাচ্ছেন, তা ভিয়েনা কনভেনশনের মধ্যে পড়ে না বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আতিকুর রহমান।
তিনি বলেন, তাদের তৎপরতা ভিয়েনা কনভেনশনের মধ্যেই নেই। বাংলাদেশে তারা যেসব কার্যক্রম চালায়, তাতে তারা কোনো কনভেনশন মানেন না। ফ্রান্সে যে আন্দোলন হচ্ছে, সেখানে তো বাংলাদেশের দূতাবাস আছে। কিন্তু তারা কোনো বিবৃতি দেয়নি। একটি জিনিস বুঝি না, সেখানে কতগুলো মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, কতগুলো মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কী হুলস্থুল অবস্থা, সেখানে তো কোনো দূতাবাস থেকে বিবৃতি দেয়া হয়নি।
‘আমরা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনো কোনো বিবৃতি দেইনি। এমনকি ফ্রান্সের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দূতাবাসও কোনো বিবৃতি দেয়নি।’
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এমন হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের (বিদেশি কূটনীতিক) মাথায় তুলে নাচি। আমাদের দোষেই তারা এগুলো করতে সাহস পান। আমাদের জন্য। আমরা নিজেদের সম্মান নিজেরাই নষ্ট করেছি। নিজেদের কোনো ব্যক্তিত্ব রাখিনি। রাজনীতিবিদরা আমাদের দেশের মানসম্মান শেষ করে দিয়েছে।’
এসব দেখে অসম্ভব খারাপ লাগার কথা জানিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘কীভাবে তারা এসব করতে সাহস পান? তারা এমনভাবে বিবৃতি দেন, যেন তাদের অধীনে আমাদের দেশ চলে। আজ আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনো শক্তিশালী দেশ হতাম, তারা এসব করতে সাহস করতেন না।’
বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা পরিষ্কারভাবে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক অবসরপ্রাপ্ত সচিব ওয়ালিউর রহমান।
সময় সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কূটনীতিকদের অ্যাকটিভিজমের কোনো জায়গা নেই। পৃথিবীর কোনো দেশে তারা এ রকম ব্যবহার করতে পারেন না, করেন না।
‘আফ্রিকাতে তারা হয়ত করেন, আমি ঠিক জানি না। আগে তারা সেখানে উপনিবেশ তৈরি করেছে, লুটপাট করেছে। ইউরোপের শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকাকে লুট করেছে। এখন লুট করতে না পারলেও তারা দেখাতে চায়, তারা আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ,’ বলেন তিনি।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। আমি তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত। কারণ বিদেশি কূটনীতিকরা এখানে যা করছেন কিংবা বলছেন, তা তাদের উচিত না। আমরা খুবই সতর্ক এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। আর এটিই প্রাথমিক ভুল। তাদের এসব করতে দেয়া উচিত না।