দীর্ঘ চার বছর পর সিলেট যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সদ্যসমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে সিলেটে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের তিন সপ্তাহের মাথায় আজ সকাল ১১টায় সিলেট যাচ্ছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে প্রস্তুত সিলেটবাসী।
প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফরকে ঘিরে নগরজুড়ে নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তার জনসভা ও অবস্থানস্থলে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। লাখো মানুষের সমাবেশের মঞ্চ প্রস্তুত সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে। বিকেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষন দেবেন তিনি। আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর এটাই হবে তার প্রথম সিলেট সফর। গত মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে ২০১২ সালে ২৪ মার্চ তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন। চার বছর পর একই স্থানে আবারও জনসভায় ভাষণ দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমুদ্রে রূপ দিতে সামর্থের সর্বোচ্চটুকু ব্যয় করছেন ক্ষমতাসীন দল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রীর সফর হওয়ায় প্রশাসনে এখন চলছে তুমুল ব্যস্ততা। সফর ঘিরে নেয়া হয়েছে ছয় স্তরের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সফরকালে নির্দিষ্টসময়ে নগরের প্রধান সড়কে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে মহানগর পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি : বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সিলেট পৌঁছার কথা। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। ওখান থেকে প্রথমে হজরত শাহজালাল (রাহ.) ও হজরত শাহপরান (রাহ.) মাজার জিয়ারত করবেন। এরপর দুপুর ১২টায় তিনি মদনমোহন কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবে যোগ দেবেন।
সোয়া ১টার দিকে সিলেট সার্কিট হাউজে ফিরে নামাজ ও মধ্যহ্ন ভোজের বিরতি। এরপর বিকেল ৩টায় তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের জনসভায়স্থলে পৌঁছবেন। সেখানে পৌঁছে প্রথমে তিনি দশটি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ১২টির ভিত্তিস্থাপন করবেন। অস্থায়ীভাবে এসব প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে মাঠের একপাশে। এরপর জনসভায় যোগ দিয়ে বিকেল ৫টার দিকে ফের হেলিকপ্টারে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর সূচি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রচার উৎসব সিলেটে : প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ঘিরে উৎসবের আমেজ এখন সিলেটে। বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে নগরী। তৈরি হচ্ছে সুসজ্জিত মঞ্চ। একদিকে প্রধামন্ত্রীর সফর। অন্যদিকে সদ্যসমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রায় নিরঙ্কুশ বিজয়, প্রচারণায় এনেছে উৎসব আর আত্মগৌরবের আমেজ।
প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে নগরে শোভা পাচ্ছে বড় বড় বিলবোর্ড, ঝুলছে ডিজিটাল ব্যানার-ফেস্টুন, সাটানো হয়েছে চাররঙা পোস্টার। এয়ারপোর্ট রুট থেকে নিয়ে জনসভাস্থলসহ নগরীর প্রধান সবগুলো সড়কের স্থানে স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে তোরণ। মাসের শুরু থেকেই চলছে প্রচার-প্রচারণা। নগরী ছাড়িয়ে এই প্রচারণা চলেছে সিলেট বিভাগজুড়ে। প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর সফর সফলে আনন্দ মিছিল-কর্মীসভা-স্বাগত শোভাযাত্রা করছেন।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও এসএসএফের সদস্য ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় পরিদর্শন করছেন জনসভাস্থলসহ প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচিভুক্ত এলাকা। প্রধানমন্ত্রীর সফর বিষয়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান জানান, প্রধানমন্ত্রীর সফর ও জনসভা সফল করতে তারা একযোগে কাজ করছেন। স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি দিনদিন মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি সেই ভালোবাসা থেকেই আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের জনসভায় লাখো মানুষ উপস্থিত হবেন।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা : প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে বেশ তোড়জোড় চলছে। নিরাপত্তার সমন্বয় করার জন্য এক বাহিনী অন্য বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে মিলিত হচ্ছে। সফরকে নির্বিঘ্ন করতে গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাব, পুলিশ মিলে চলছে দফায় দফায় বৈঠক। সিলেটজুড়ে ছয় স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)। তবে পুরো সফরে নিরাপত্তা দিকটি সমন্বয় করবে সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি)। তাদেরকে সাহায্য করবে গোয়েন্দা সংস্থা এবং র্যাবের সদস্যরা।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহাল থাকবে। ইনার কর্ডন, আউটার কর্ডন, রোড ব্যবস্থাপনা, রুফটপ, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ও সাদা পোশাকধারী- এই ছয়টি স্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পুলিশ।
এসএমপি সূত্রে জানা যায়, সিলেট মহানগরীর ছয়টি থানার পুলিশ সদস্য ছাড়াও মহানগরীর বাইরে থেকে জেলা পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্যকে নিরাপত্তা কাজের জন্য নিয়ে আসা হবে। সবমিলিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য পুরো সিলেটজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানা গেছে।
পুলিশের মূল নজর থাকবে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থল, মদনমোহন কলেজের অনুষ্ঠানস্থল, তার যাত্রাপথ এবং আশপাশের এলাকা। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নিরাপত্তার স্বার্থে নগরীর বিভিন্ন হোটেল, গেস্ট হাউস, মেস এবং বাসা-বাড়ির দিকেও নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থলের আশপাশের সকল ভবনে বিশেষ নজরদারি রাখা হবে। এসব ভবনের ছাদে সশস্ত্র পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। প্রধানমন্ত্রী আসবেন আজ বৃহস্পতিবার, এর আগের দিন বুধবার আগের দিন থেকেই তার অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশের ভবনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে পুলিশ।
সিসি ক্যামেরার আওতায় জনসভা : সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া বিষয়ক কর্মকর্তা (এডিসি) রহমত উল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থলসহ আশপাশের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে অর্ধশতাধিক সিসি ক্যামেরার বসানো হচ্ছে। মঙ্গলবার থেকে এ ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ১ সপ্তাহ থেকে পুলিশ ও ১ মাস আগ থেকে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।
যেসব প্রকল্পের উদ্বোধন : উদ্বোধন অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইসিটি ভবন, আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স, জৈন্তাপুর উপজেলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, এপিবিএম এর ব্যারাক ভবন, ওসমানীনগর থানা ভবন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নির্মিত হোস্টেল ভবন, মাছিমপুর এলাকার সুরমা নদীর তীরে নির্মিত ওয়াকওয়ে, এমসি কলেজের মাঠের সীমানা প্রাচীরের গেইট, সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালকে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট শিশু হাসপাতালে রূপান্তর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন।
যেসব প্রকল্পের ভিত্তিস্থাপন : এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সিলেট আউটার স্টেডিয়াম, খসরুপুর বাজার জিসি-পৈলনপুর-বালাগঞ্জ জিসি সড়ক উন্নয়ন, হরিপুর জিসি-গাছবাড়ী জিসি সড়ক (কানাইঘাট অংশ), মৈয়াখালী বাজার-আরঅ্যান্ডসুইচ (বারোহাল ইউপি অফিস) ভায়া হাটুবিল মাদ্রাসা সড়ক উন্নয়ন, নারী পুলিশ ডরমেটরি ভবনের অর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ, শাহপরান থানা ভবন নির্মাণ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বিভাগীয় ও জেলা অফিস নির্মাণ, সিলেট বিভাগীয় ও জেলা এপিএসআই কার্যালয় ভবন নির্মাণ, তামাবিল স্থলবন্দর নির্মাণ, জিরত গাজী বোরহান উদ্দিন (রহ.) মাজার, তিনতলা ভিত্তি বিশিষ্ট মসজিদ, মহিলা এবাদতখানা ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) সিলেট বিভাগ এবং সিভিল সার্জন সিলেট কার্যালয় ভবন নির্মাণ কাজ ও সিলেট ইলেক্ট্রনিক সিটি।
‘সাতকরায়’ আপ্যায়িত হবেন প্রধানমন্ত্রী : সিলেটের স্বতন্ত্র খাবার সাতকরার (হাতকরা) প্রতি ভোজন রসিকদের আগ্রহের মাত্রা একটু বেশি। গরুর মাংসের সঙ্গে সাতকরা, সুস্বাদু এক তরকারির নাম। একবার খেলে, কখনো স্বাদ ভোলা যায় না- এমনই গুণ সাতকরায়।
সাতকরার গুণে মুগ্ধ সকলে। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও মন পড়ে আছে সাতকরায়। গত বছরের ৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সিলেটের কাজীরবাজার সেতুসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন কালে বলেন, ‘আমি অনেকবার সিলেটে গিয়েছি। কিন্তু সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস কখনো খাইনি। সাতকরার দিয়ে গরুর মাংসের অনেক প্রশংসা শুনেছি। তাই এই আইটেমটি না খাওয়ার জন্য আমার আফসোস রয়ে গেছে। আমি আগামীতে সিলেট গেলে অবশ্যই গরুর মাংস দিয়ে সাতকরা খেতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী সেই ইচ্ছে পুরণ হচ্ছে আজ। সকালে সিলেট পৌঁছার পর শাহজালাল, শাহপরান (রাহ.) মাজার জিয়ারত, মদনমোহন কলেজের হীরকজয়ন্তীতে যোগদান শেষে নামাজের বিরতি ও মধ্যাহ্ণভোজ হবে সিলেট সার্কিট হাউজে। খাবারের অন্যান্য পদের সঙ্গে হাতকরার পদও পরিবেশিত হবে প্রধানমন্ত্রীর জন্যে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের সব খাবারই মেনুতে থাকবে। বিশেষভাবে থাকবে সাতকরা দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস।