বিচার অঙ্গনে সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা নাম সমধিক পরিচিত। প্রধান বিচারপতি হিসেবে পূর্ণ হলো এক বছর। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার আমলে। দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি নানামুখী পরিকল্পনা নিয়েছেন। যার ফলে বেড়েছে বিচারকার্যের গতি।
২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা। এর মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসে এই প্রথম সনাতন ধর্মাবলম্বীর কেউ প্রধান বিচারপতি পদ গ্রহণ করেন। শপথ নেয়ার পরদিন ১৮ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতিকে এক নম্বর এজলাসে সংবর্ধনা দেয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়। ওই সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি মামলার জট কমানো, সুপ্রিম কোর্টের ছুটি হ্রাস, নিম্ন আদালতের বিচার কাজে গতি বৃদ্ধি এবং নিয়ন্ত্রণসহ দেশে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষায় উচ্চ আদালতের ভূমিকার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
সিনিয়র আইনজীবীরা মনে করেন, এর ধারাবাহিকতায় সংস্কারমূলক অনেকগুলো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাই বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশন, কার্যকর আদালত প্রশাসন ও মামলা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মামলাজট সহনীয় পর্যায়ে আনার পথে বিদ্যমান সমস্যা, সম্ভাবনা ও সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে গত ডিসেম্বরে ঢাকায় সম্মেলন হয়েছিল।
বিচারপ্রার্থী জনগোষ্ঠীকে আইনি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের আদালতগুলোতে কর্মরত কর্মচারীদের অনিয়ম, দায়িত্বে অবহেলা, অসদাচরণ সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ এবং তার প্রতিকার বিধানের জন্য সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ ও পরামর্শ বক্স স্থাপন করা হয়েছে।
গত এক বছরে দেশের আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে শতকরা ১৬২ ভাগ। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০৭ শতাংশ বেশি। ২০১৪ সালে আপিল বিভাগে ৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল সেখানে ২০১৫ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার।
নিম্ন আদালতেও প্রায় ১১ লাখ মামলা নিষ্পত্তি হয়। যা ২০১৪ সালের তুলনায় এক লাখেরও বেশি। এবার চলতি ২০১৬ সালকে মামলার জট দূর করার বছর ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু মামলা নয় সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক ছুটিও কমেছে। এ ছাড়াও বিচারাঙ্গনে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দিনের মামলা তালিকাও প্রকাশ করা হচ্ছে অনলাইনে ।
এছাড়া সিনিয়র বিচারপতিদের নিয়ে বেঞ্চ পুনর্গঠন, সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগ, সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর পরে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত রাখাসহ পূর্ণ কর্মঘণ্টা কাজের নির্দেশনা জারি করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ফলে বিচার বিভাগে গতি এসেছে বলে বলছেন সিনিয়র আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতিকে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহাবুব হোসেন বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারতির পদক্ষেপের কারণে এবার অনেক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সরকারের চাপের কারণে মামলা নিষ্পত্তি কিছুটা কম হয়েছে। তা না হলে আরো অনেক মামলা নিষ্পত্তি হতে পারতো।
জামিন আদেশ জানা যায় অনলাইনে:
হাইকোর্টে আসামির জামিন হলে নিম্ন আদালতে আদেশের কপি পাঠিয়ে জামিনের বিষয়টি জানানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় মাঝে মধ্যে হাইকোর্টের আদেশের কপি জাল বলে খবর প্রকাশ হতো। অনেক সময় নিম্ন আদালত থেকে ফোনে আদেশের তথ্য জেনে নেয়া হতো। এ প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ এবং হয়রানিমূলক। এই অবস্থায় অক্টোবর থেকে সুপ্রিম কোর্টে চালু হয়েছে ‘বেইল কনফার্মেশন সফটওয়্যার’। এই সফটওয়্যারে প্রতিটি জামিনের আদেশ স্ক্যান করে নিম্ন আদালতে পাঠানো হয়। নিম্ন আদালত স্ক্যানকৃত আদেশের সঙ্গে তাদের কাছে আসা আদেশের মিল আছে কি না তা যাচাই করেন। মিল থাকলে আসামিকে জামিনে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
কমেছে সুপ্রিম কোর্টের ছুটি:
সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি তিন দিন হ্রাস করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ফুল কোর্ট সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি ছিল ৬৫ দিন। চলতি বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ দিনে।
সূত্রে জানা যায়, অবকাশকালীন ছুটি ২৫ দিন কমানোর প্রস্তাব করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। ফুল কোর্ট সভায় এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার পরে ৩ দিন কমানো হয়।
কজলিস্ট অনলাইনে:
বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশনের অন্যতম পদক্ষেপ হচ্ছে অনলাইন কজলিস্ট (দৈনন্দিন কার্য তালিকা)। এ ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের কজলিস্ট অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। মামলার শুনানির আগে রাত ৮টার মধ্যে পরের দিনের কোর্টের কজলিস্ট অনলাইনে দেখা যায়। এর আগে এ ব্যবস্থা ছিল শুধু আপিল বিভাগের ক্ষেত্রে।
জানা গেছে, দেশের জেলা আদালতগুলোর মামলার কার্যতালিকাও পর্যায়ক্রমে অনলাইনে করা হবে।
মামলা নিষ্পত্তির হার:
সুপ্রিম কোর্টের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত আপিল বিভাগে ৯ হাজার ৩৫৬টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৩৩ হাজার ৩৮০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৪ সালে একই সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল আপিল বিভাগে ৫ হাজার ৭৮৯টি ও হাইকোর্টে ২২ হাজার ৪৭৭টি। নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ১৬২ ভাগ।
এদিকে নিম্ন আদালতের বিচারকগণ ২০১৫ সালে মামলা নিষ্পত্তি করেছেন ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৩টি। এর আগের বছর একই সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৯ লাখ ৯৭ হাজার ৬৫২টি। মামলা নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ১০৭ ভাগ।
মামলা জট নিরসনের বছর ঘোষণা:
গত ২৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করা হয়েছিল প্রথম জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন। সম্মেলনে দেশের নিম্ন আদালতের ১৪শ’ বিচারক অংশ নেন। সম্মেলনে ২০১৬ সালকে মামলা জট নিষ্পত্তির বছর হিসেবে ঘোষণা দেন প্রধান বিচারপতি।
বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থায় মামলা জট ও বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা জনগণের বিচার লাভের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। নিম্ন আদালতগুলোতে প্রায় ২৭ লাখ মামলাজট আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের অবশ্যই মামলাজটের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হবে। এজন্য আদালতের পুরো সময়কে বিচার কাজে ব্যয় করতে হবে।
পুরস্কার প্রবর্তন:
আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় স্বতন্ত্র এবং কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সুপ্রিম কোর্ট কোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, ব্যক্তি অথবা সরকারি কর্মকর্তাকে ‘প্রধান বিচারপতি পুরস্কার’ এ ভূষিত করবে। আইনের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করাই হবে পদক প্রদানের উদ্দেশ্য। প্রধান বিচারপতির এ পুরস্কারের মধ্যে পদক, স্মারক ও সম্মাননাপত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
হাইকোর্ট বিভাগের নথি ব্যবস্থাপনা:
অভিযোগ রয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগে অনেক সময় মামলার নথি খুঁজে পাওয়া যেত না। প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন নির্দেশনার মাধ্যমে মামলার নথি এবং তার আদেশের কপি সংরক্ষণে শৃঙ্খলা এনেছেন। এ বিষয়ে শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে নথি ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ফলে নথি ব্যবস্থাপনায় পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি স্বচ্ছ ও গতিশীল এসেছে।
অভিযোগ বাক্স স্থাপন:
সুপ্রিম কোর্টে স্থাপন করা হয়েছে অভিযোগ বাক্স। বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলা সম্পর্কিত অভিযোগ এই বাক্সে দেয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ব্যবস্থা আগেও ছিল। কিন্তু কয়েক দিন যাওয়ার পর ওই বাক্স আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বর্তমান প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর পুনরায় অভিযোগ বাক্স স্থাপন হয়। বাক্স স্থাপনের পর এ পর্যন্ত ১০৩টি অভিযোগ নিষ্পত্তির উদ্দেশে কমিটি কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অভিযোগ যাচাই-বাছাই করার জন্য গঠন করা হয়েছে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি।
জেলা জজের পদ সৃষ্টি:
দেশের আদালতগুলোতে জেলা জজের অনেকগুলো পদ শূন্য ছিল। বর্তমান প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর জেলা জজ পদমর্যাদার ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল (সহায়ক পদসহ) সৃজনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের রিসার্চ ইউনিটের সহায়তায় একটি অনলাইন বুলেটিন (ল রিপোর্ট) চালু করা হয়েছে। বুলেটিনে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রকাশ পেয়ে থাকে।
প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট মেডিকেল সেন্টারের বিদ্যমান সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। তৈরি হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ডাটা বেইজ। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শিশু সন্তানদের দেখাশুনার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ডে-কেয়ার সেন্টার।