ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),জামালপুর প্রতিনিধি ,বৃহস্পতিবার, ২২ জুন ২০২৩ :জামালপুরে সাংবাদিক নাদিম হত্যার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন অন্যতম আসামি ফাহিম ফয়সাল রিফাত (২৩)। তিনি ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর ছেলে। নাদিম হত্যা মামলায় বাবু পাঁচদিনের রিমান্ডে আছেন। রিফাত গ্রেফতার না হওয়ার পেছনে বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল রানাকে দায়ী করছেন সাংবাদিকরা।
Advertisement
স্থানীয় ও পরিবার সূত্র জানায়, সংবাদ প্রকাশের জেরে অনেক আগেই সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। এ নিয়ে দফায় দফায় উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে মিটিং এবং হুমকি-ধামকি দিয়েছেন সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুসহ অনেকে। মঙ্গলবার (২০ জুন) সকাল থেকে বুধবার (২১ জুন) বিকেল পর্যন্ত এমন দুটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে।
গত ১১ এপ্রিল সাংবাদিক নাদিমকে নির্যাতনের ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমকে প্রধান আসামি করে পাঁচজনের নামে বকশীগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সেই অভিযোগ আমলে না নিয়ে বিভিন্ন টালবাহানা করেন ওসি সোহেল রানা। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ফেসবুকে লাইভ করেছিলেন সাংবাদিক নাদিম।
১০ মে সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর বিরুদ্ধে সন্তানের স্বীকৃতি ও স্ত্রীর মর্যাদার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন সাবিনা ইয়াসমিন নামের এক নারী। দাবির সপক্ষে সংবাদ সম্মেলনে দুটি কাবিননামা সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন ভুক্তভোগী। এ নিয়ে বাংলানিউজসহ একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে ক্ষুব্দ হন চেয়ারম্যান। পরে ১৭ মে ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিক নাদিমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। ১৪ জুন মামলাটি খারিজ করে দেন ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল।
পরে ওইদিন রাতে পেশাগত দায়িত্বপালন শেষে বকশীগঞ্জ বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলেন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম। তিনি পাটহাটি এলাকায় পৌঁছালে পূর্ব পরিপরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ত্রাসীরা তার ওপর হামলা চালায় এবং মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে একটি অন্ধকার গলিতে নিয়ে যায়। পরে চেয়ারম্যানপুত্র রিফাত ইট দিয়ে নাদিমের মাথায় সজোড়ে আঘাত করেন। এসময় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন চেয়ারম্যান নিজেই।
মারধরে সাংবাদিক নাদিম অচেতন হয়ে পড়লে তাকে ফেলে পালিয়ে যান হামলাকারীরা। পরে স্থানীয়রা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। খবর পেয়ে ওসি সোহেল রানা ছুটে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু ফিরে দায়সারা বক্তব্য দেন সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, ‘সামান্য চোখে আঘাত পেয়েছেন সাংবাদিক নাদিম’।
পরে অবস্থার অবনতি হলে রাত ১২টায় সাংবাদিক নাদিমকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল এবং পরদিন সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৫ জুন বিকেল পৌনে ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ওইদিন ওসি সোহেল রানার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় চোখের সামান্য আঘাতে তিনি মারা গেলেন কীভাবে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘বাহ্যিকভাবে তিনি এটাই ভেবেছিলেন’।
অভিযোগ রয়েছে, ওসির এমন দায়সারা বক্তব্য আর অবহেলার কারণে একে একে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন চেয়ারম্যান ও তার পুত্রসহ বাকি আসামিরা। পরে র্যাবের অভিযানে পঞ্চগড় থেকে চেয়ারম্যানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে মামলার প্রধান আসামি ফাহিম ফয়সাল রিফাতসহ এজাহারভুক্ত অনেক আসামি। রিফাত সদ্যবহিষ্কৃত বকশীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক।
১৯ জুন নাদিম হত্যার মামলাটি জামালপুর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ বিষয়ে জেলা ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরমান আলী জাগো নিউজকে বলেন, এরই মধ্যে মামলাটির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগির বাকি আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
স্থানীয় সাংবাদিক এমদাদুল হক লালন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনায় কোনোভাবেই ওসি সোহেল রানা দায় এড়াতে পারেন না। নাদিম মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আসামিরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছেন এলাকায়। এর আগেও একাধিকবার নাদিম হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু ওসি কোনো ব্যবস্থা নেননি। মূলত তার অবহেলায় সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমকে মেরে ফেলার সাহস পেয়েছেন চেয়ারম্যান ও তার পুত্র।’
Advertisement
জামালপুর অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর জাগো নিউজকে বলেন, সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম তার সংগঠনের সহ-সভাপতি ছিলেন। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল রাতে নাদিম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের লোকজনের হামলার শিকার হয়েছিলেন। তখন সংগঠনের পক্ষে তিনি বকশীগঞ্জ গিয়েছিলেন এবং থানায় নাদিমের লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওসি সোহেল রানা কোনো ব্যবস্থা নেননি। এবারও নাদিম আহত হওয়ার পর ওসি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘চোখে সামান্য আঘাত পেয়েছেন’।
তিনি বলেন, নাদিমের মৃত্যুর পর ওসি মন্তব্য করেন, ‘বাবু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সাংবাদিকরা লিখলেও সবাই একসময় থেমে যায়, কিন্তু নাদিম না থেমে ধারাবাহিক নিউজ করছিল এবং ফেসবুকে শেয়ার দিচ্ছিল। তাই বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়। সুতরাং সাংবাদিকতার জন্য এ হত্যা হয়নি’! কতটা পক্ষপাতিত্ব করলে ওসি এমন মন্তব্য করতে পারেন, তা সুস্পষ্ট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ উপজেলায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক চেয়ারম্যান জেলে রয়েছেন। তাই গাফিলতি করার প্রশ্নই ওঠে না।’
তিনি আরও বলেন, নাদিম হত্যাকাণ্ডের পরপরই তিনি হাসপাতালে ছুটে যান এবং আধাঘণ্টার মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে আসামিদের শনাক্তের চেষ্টা করেন।
বক্তব্য জানতে জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দীন আহমেদের ফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি।
Advertisement
তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দেওয়ানগঞ্জ সার্কেল) সুমন কান্তি চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, তিনি এখন ঢাকায় রয়েছেন। তাই এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি নন।