কানাডায় স্ত্রীর নামে বাড়ি ব্যাংকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা(ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),নাটোর প্রতিনিধি ,মঙ্গলবার, ২০ জুন ২০২৩:নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের দুবারের জাতীয় সংসদ-সদস্য (এমপি) শফিকুল ইসলাম শিমুল নিজ দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান তিনি। নির্বাচনি এলাকার নিজ দলের দুই উপজেলা চেয়ারম্যান ও দুটি পৌর মেয়রসহ বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তার দা-কুমড়া সম্পর্ক। জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তার কোনো সম্পর্ক নেই। জেলার সব এমপির অবস্থানও তার বিরুদ্ধে। দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ-বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে টিআর-কাবিখা বরাদ্দে এমপি শিমুল ব্যাপক অনিয়ম লুটপাট করেছেন। নিয়োগবাণিজ্য করে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। দুর্নীতির টাকায় এমপি শিমুল নাটোর ও কানাডার বেগমপাড়ায় স্ত্রীর নামে বিলাসবহুল দুটি বাড়ি করেছেন। এছাড়া কানাডাসহ দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিনিধির নামে তিনি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রেখেছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, আয়কর ফাইল অনুযায়ী এমপি শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতি একজন গৃহবধূ। কিন্তু তার নামে দেশ-বিদেশে রাজপ্রাসাদসম দুটি বাড়ি রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জান্নাতির সম্পদ ছিল ২ কোটি ১৪ লাখ টাকার। পরের বছর তার সম্পদ বৃদ্ধি পায় ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে তার সম্পদ বেড়েছে ৪ কোটি ২২ লাখ টাকার বেশি। সম্পদ বৃদ্ধির হার ২৮৪ শতাংশ। যা রীতিমতো বিস্ময়কর।

কানাডার ব্যাংকে এমপি শিমুলের অর্থ লেনদেনের তিনটি অ্যাকাউন্টের (ব্যাংক হিসাব) তথ্য যুগান্তরের কাছে আছে। এরমধ্যে তার নিজের নামে দুটি এবং কানাডার একজন নাগরিকের নামে অপরটি রয়েছে। কানাডিয়ান ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব কমার্সে তার একটি অ্যাকাউন্ট (সিআইবিসি ২০০০০০০পি) এবং ব্যাংক অব নোভা স্কোটিয়ায় আরেক অ্যাকাউন্ট (৩০০০০০০পি) রয়েছে। একটি ব্যাংক থেকে তিনি মাস্টার কার্ডও (৪৬৩৯৪৩১৮৫৮৭৯৬০৭৮) নিয়েছেন। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব অ্যাকাউন্টে তার ৪৬ লাখ ৫১ হাজার ১৬২ কানাডিয়ার ডলার (৩১ কোটি ৬২ লাখ টাকা) ছিল। এছাড়া কানাডার নাগরিক রাডি অর্নল্ডের নামে (কার্ড নম্বর ৫০৬১৯৭৩৯৩১৫৩৬৪৪৮) তিনি অর্থ লেনদেন করেছেন। এমপি শিমুলের স্ত্রী জান্নাতির নামে কানাডায় বিলাসবহুল বাড়ির তথ্য জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

জানা গেছে, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালে শফিকুল ইসলাম শিমুল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সদর আসন থেকে তিনি প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।

এমপি শিমুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ-জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে নিজের পরিবারের ১২ জনকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদে বসিয়ে তিনি দল নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তিন ভাই ও ভগ্নিপতিদের দিয়ে নাটোরের সব লাভজনক খাতও তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিএনপি-জামায়াতের লোক এনে তিনি হাইব্রিড আওয়ামী লীগ তৈরি করে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের অভিযোগ-এমপি শিমুলের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমানসহ দলের অনেক প্রবীণ নেতাকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।

২০২১ সালের শুরুতে এমপি শিমুল বিরোধী হিসাবে পরিচিত ইসতিয়াক আহমেদ ডলার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এবং শফিউল আযম স্বপন সাধারণ সম্পাদক হন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এমপি শিমুল সমর্থিত জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আগের আহ্বায়ক কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে ডলারের বাবা রাজাকার বলে দাবি করা হয়। পালটা সংবাদ সম্মেলনে এমপি শিমুলের বাবাই রাজাকার বলে দাবি করেন ডলার। এতে দলে চরম দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ জেলার বাকি চার এমপি একাট্টা হয়ে শিমুলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তিনি দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এমপি শিমুল সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান। ৭১ সদস্যের জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে শেষের দিকে ২-৪ জন নেতা ছাড়া তার পক্ষের কোনো লোকজনও নেই। আগের কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান নতুন সাধারণ সম্পাদক হন।

Advertisement

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সংগঠন ছাড়াও জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি, দলিল লেখক সমিতি ও স্বনির্ভর সমবায় সমিতিসহ জেলা সদরের বিভিন্ন কমিটি নির্বাচনে এমপি শিমুলের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়। সম্প্রতি নাটোর সদর স্বনির্ভর সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান পদে শিমুলের বড় ভাই শরিফুল ইসলাম শরীফকে বিপুলে ভোটে পরাজিত করেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইসতিয়াক আহমেদ ডলার। ডলারের বিজয় মিছিলে এমপি শিমুল অনুসারীরা প্রকাশ্যে হামলা করে।

নাটোর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক শেখ যুগান্তরকে জানান, গোরস্থান, মসজিদ, মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবখানে এমপি শিমুল অনিয়ম করেছেন। সব প্রতিষ্ঠানের টিআর-কাবিখা বরাদ্দে তিনি ব্যাপক অনিয়ম লুটপাট করেছেন। ছাতনী শিবপুর মসজিদে তিন টন চাল বরাদ্দ দিয়ে চালের পরিবর্তে তিনি মাত্র ১৪ হাজার টাকা দিয়েছেন। নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, লুটতরাজ, দুই উপজেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগবাণিজ্য করে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। ১০ বছরে দেশ-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি সম্পদ গড়ে এমপি শিমুল শুধুই নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন করেছেন। কানাডার বেগমপাড়া এবং নাটোরের কান্দিভিটুয়ায় জান্নাতি প্যালেস নামে তিনি দুটি বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। নিজের আÍীয়স্বজন ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য তিনি কিছুই করেননি। তার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়।

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মালেক আরও বলেন, এমপি শিমুলের সঙ্গে এখন আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীই শুধু নন, সাধারণ মানুষেরও কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনীতিতে তিনি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছেন। দেশ ছেড়ে মাঝে-মধ্যে কানাডার বেগমপাড়ায় অবস্থান করায় তার দিক থেকে নেতাকর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র কায়েম করায় তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। এমপি শিমুলের কাছ থেকে নেতাকর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে তাকে (শিমুল) মনোনয়ন না দেওয়ার পাশাপাশি দলীয় পদে না রাখার জন্য মালেক শেখ দাবি জানান।

Advertisement

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান জানান, এমপি শিমুলের সঙ্গে দলের সম্পৃক্ততা নেই। নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি (শিমুল) প্রতারণা করেছেন। চাকরি দেওয়ার নামে তিনি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা নিয়েছেন। তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তিনি নির্যাতন করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে শিমুল টাকার বিনিময়ে দলীয় পদ বিক্রি করেছেন। নেতাকর্মীর মতামতকে কখনো মূল্যায়ন করেননি। বহু নেতাকর্মীকে তার পেটুয়া বাহিনী অত্যাচার নির্যাতিত করেছে। এ কারণে নেতাকর্মীরা তাকে আর পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের সঙ্গেও তার কোনো সম্পর্ক নেই। এজন্য সব শ্রেণির মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা পরিবর্তন চায়। আসনটি আওয়ামী লীগের। তাকে পরিবর্তন করলে ভবিষ্যতেও আসনটি আওয়ামী লীগের ঘরেই থাকবে।

নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) আসন থেকে পাঁচবার নির্বাচিত এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস জানান, আমার সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে এমপি শিমুল আমার সঙ্গে শত্রুতা করেন। জেলা শহরের মানুষ না হওয়ায় অস্ত্রের মুখে শিমুল আমাকে নাটোর শহর ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। দল ক্ষমতায় থাকলেও জেলা সভাপতি হিসাবে আমি সদরে সাত বছর কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারিনি। এখন তাকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারাতে হয়েছে। নেতাকর্মীরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায়।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ নেতাদের সব অভিযোগ অস্বীকার করে নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল যুগান্তরকে জানান, আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাই স্বাভাবিক। তবে অনেকের পায়ের নিচে মাটি না থাকলেও তারা জেগে জেগে আগামী দিনে এমপি হওয়ার দিবা স্বপ্ন দেখছেন। আর ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছেন। এসব মানুষই তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছেন। তৃণমূলের সাধারণ মানুষ আমাকেই ভালোবাসে এবং আগামী দিনে তারা আমাকেই এমপি হিসাবে দেখতে চায়।

দেশ-বিদেশে নিজের ও স্ত্রীর নামে-বেনামে বাড়ি-গাড়ি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা প্রসঙ্গে এমপি শিমুল জানান, এসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। যেসব সম্পদ আছে সেসব পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। মূলত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তার বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা তথ্য দেওয়া হচ্ছে। যারা এমন অভিযোগ করছেন-থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও আমেরিকায় তাদেরও বাড়ি রয়েছে। তাদেরও ব্যাংকে অনেক অবৈধ টাকা গচ্ছিত আছে।