বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রী ও নেতাদের অতিকথন, পরস্পরবিরোধী ও বিতর্কিত মন্তব্য পিছু ছাড়ছে না আওয়ামী লীগের। চরম সমন্বয়হীনতায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এতে অনেক সময়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের।
একজনের বিতর্কিত মন্তব্যের রেশ না কাটতেই অন্য আরেকজন একই ধরনের ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। ধারাবাহিক এসব কর্মকাণ্ডে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে সরকার ও দলের। পরিস্থিতি সামাল দিতে কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য প্রত্যাহার করছেন। আবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইউটার্ন নিয়ে একই নেতা একবারেই উলটো বক্তব্য দিচ্ছেন।
‘অতিকথন বা বিতর্কিত মন্তব্য’র কারণে অতীতে (আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের দ্বিতীয় দফা) এক নেতাকে মন্ত্রিত্বসহ দলীয় পদ হারাতে হয়েছে। এমন দৃষ্টান্ত থাকার পরও বন্ধ হচ্ছে না মন্ত্রী-নেতাদের অতিকথন।
মন্ত্রী-নেতাদের এমন সমন্বয়হীন কথাবার্তায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীও হতাশ। ‘বিরক্ত’ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারাও। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো বিষয়ে ফোরামে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগেই নেতা-মন্ত্রীরা নানা ধরনের মন্তব্য করে ফেলেন। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, এগুলো (সমন্বয়হীন কথাবার্তা) আসলে সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ গণমাধ্যমকর্মীরাও অনেক সময় কিছু কথা ঢুকিয়ে দেন। এ কারণে কথা বলার সময় অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নেতা-মন্ত্রীরাও অতিরিক্ত কথা বলে ফেলেন এবং মনে করেন এটা তাদের ক্রেডিট। কিন্তু আসলে তা নয়। এ বিষয়ে তাদেরও আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
Advertisement
জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দেশে নেতা ও মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন রকমের কথা বলেন। আবার বলেন, এটা ব্যক্তিগত মতামত। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার একটি নজির। এটি নতুনও নয়, এটি চলছে। কিন্তু আমরা এটি ঠিক করতে পারছি না। ফলে অনেক সময় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হন। এর মধ্য দিয়েই কিন্তু সন্দেহ, অবিশ্বাস, অনাস্থা গড়ে ওঠে। এর সমাধান হওয়া জরুরি।
এদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের সমন্বয়হীন এবং অতিকথনে ‘বিরক্ত ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারাও। জোটের একাধিক সভায় তাদের এ বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি নেতা-মন্ত্রীদের আরও বেশি সতর্ক হয়ে কথাবার্তা বলার পরামর্শ দিয়ে বলছেন, বাছ-বিচার ছাড়াই মন্ত্রীদের স্ববিরোধী বক্তব্য নির্বাচনের আগে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। বিরোধী শক্তিগুলো এ সুযোগ নিয়ে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যা আওয়ামী লীগ কিংবা ১৪ দলের জন্য সুখকর হবে না। ৪ জুন রাজধানীর ইস্কাটনে ১৪ দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি কয়েকজন মন্ত্রীর অতিকথন নিয়েও কঠোর সমালোচনা করা হয়। জানতে চাইলে ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দায়িত্বশীল পদে যারা আছেন, তাদের এ ধরনের কথাবার্তা না বলা উচিত। যারা গুরুত্বপূর্ণ বা সাংবিধানিক পদে থাকেন তাদের রয়েসয়ে কথাবার্তা বলা উচিত। কেননা এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ সংকট, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ডলার বাজারের অস্থিরতাসহ নানা বিষয় নিয়ে এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে সরকার। এরমধ্যে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা যেন কথার খই ফোটাচ্ছেন। যে যেভাবে পারছেন কথা বলছেন। এই কথাগুলো অনেক ক্ষেত্রে সমন্বয়হীন এবং অনেক ক্ষেত্রে স্ববিরোধীও হয়ে উঠছে।
সংলাপ নিয়ে ৬ জুন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধির মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে’ বলে মন্তব্য করেন। এ ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে দেখা দেয় মতানৈক্য। প্রভাবশালী দুই নেতা ও মন্ত্রী আমুর বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী সংলাপের পক্ষে মত দেন। আর আমির হোসেন আমু নিজেও তার অবস্থান থেকে সরে আসেন। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিনিয়র নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
নেতা-মন্ত্রীদের কথায় সমন্বয়হীনতার বিষয়টি নিয়ে এর আগেও সমালোচনা হয়েছে ব্যাপকভাবে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মন্ত্রীরা একেকজনের একেক বক্তব্য সরকারকে বিব্রত করেছে। সম্প্রতি আমেরিকা নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পরেও বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মতো নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতেও মন্ত্রিপরিষদের একজন সিনিয়র সদস্য ‘মুখ ফসকে’ বিতর্কিত মন্তব্য করেন। পরে আবার নিজের বক্তব্য সংশোধনও করেন তিনি।
Advertisement
নতুন করে সামনে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ ইস্যু। এ নিয়েও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন। ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে’ জামায়াতকে ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন মন্ত্রিপরিষদের এক সিনিয়র সদস্য। একইদিন আরেক মন্ত্রী জানিয়েছেন-সমাবেশের অনুমতি দিলেও জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদের আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, জামায়াত এখনো যেহেতু নিষিদ্ধ নয়, সেজন্য তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। এদিকে মন্ত্রী-নেতাদের এমন সমন্বয়হীন কথাবার্তায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীও হতাশ। তারা বলছেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় এসব কর্মকাণ্ডে সরকারের অগ্রযাত্রাকে অনেকটা ম্লান করছে। অহেতুক সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে বিরোধী পক্ষকে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নেতা-মন্ত্রীদের কথা বলার আগে চিন্তা-ভাবনা করেই বলা উচিত।