ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩ : ছোটবেলায় একটি শিশুর বিনোদনের প্রধান খোরাক বাজারের নানা রকমের খেলনা। সন্তানকে হাসি-খুশি রাখতে অভিভাবকরা নির্ধিদ্বায় শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছেন এসব। কিন্তু পিস্তল ও চাকুর মতো খেলনা সদৃশ মারণাস্ত্র হয়ে উঠছে শিশুর ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ। এসব খেলনার মাধ্যমে শৈশব থেকে অবচেতনভাবে শিশুকে সহিংসতার দিকে উৎসাহ দিচ্ছেন খোদ অভিভাবকরা।
দৈনিক পত্রিকার পাতা কিংবা ফেসবুকের টাইমলাইন খুললেই দেখা যায়, তুচ্ছ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র কিশোর গ্রুপের হাতাহাতি ও মারামারির সংবাদ। যা এখন নিত্যদিনের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু যতদিন পার হচ্ছে, কিশোরদের অপরাধগুলো ক্রমেই বাড়ছে। মূলত কিশোর গ্যাংয়ের বীজ বপন হচ্ছে কোমলমতি শিশুর খেলাঘর থেকেই।
Advertisement
সম্প্রতি ঈদ-পূজার মতো উৎসবে দেখা যায়, শিশুকে খেলনা পিস্তল কিনে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। সেই পিস্তল দিয়ে শিশুরা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা খেলছে। বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অন্য গ্রুপকে আক্রমণ করছে। এ ছাড়া গাড়ির বদলে শিশুকে দেয়া হচ্ছে খেলনা যুদ্ধের ট্যাংক। এমনকি শিশুর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে কলম সদৃশ চাকু বা খেলনা তলোয়ার। এর মাধ্যমে ছোট বয়স থেকেই একটি শিশুর মধ্যে এসব অস্ত্রের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে থাকে। তার কাছে এসব জিনিসের ব্যবহার স্বাভাবিক মনে হয়। এতে সে যখন কিশোর বয়সে পৌঁছায়, তখন আসল অস্ত্রের ব্যবহার তার কাছে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এতে করে পিস্তল দিয়ে ভয় দেখানো থেকে শুরু করে মানুষ হত্যাও অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক মনে হয় অল্প বয়সের এসব তরুণের কাছে।
মূলত হরমোনাল ও সামাজিক প্রভাবের কারণে কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েদের আচরণগত পরিবর্তন হয়ে এক ধরনের ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব আসে। তাই কোনো কিছুকেই পরোয়া করতে চায় না তারা। এসব অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে হিরো হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টায় মেতে ওঠে। জড়িয়ে পড়ে কিশোর গ্যাংয়ের মতো ভয়াবহ অপরাধে। একদিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অন্যদিকে অভ্যাসগত অস্ত্রের ব্যবহারে এসব গ্যাং দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা লাইফ স্প্রিংয়ের সাইকিয়াট্রিস্ট হাসিবুল আজিম আকাশ বলেন, শিশুরা মূলত অনুকরণ প্রিয়। এ অবস্থায় তাদের হাতে খেলনা পিস্তল বা মারামারির অন্যান্য সরঞ্জাম তুলে দিলে শৈশব থেকে তারা ধ্বংসাত্মক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। খেলার মাধ্যমে প্রথম ৫ বছরের মধ্যে শিশুদের মেধার বিকাশ। এ সময় শিশুকে এমন কোনো জিনিস দেয়া যাবে না, যেটি তার মধ্যে সহিংসতার মনোভাব সৃষ্টি করে।
শিশুকে তাই এসব খেলনা না দিয়ে বিভিন্ন ইনডোর ও আউটডোর গেমস খেলার প্রতি উৎসাহ দেয়ার পরামর্শ দেন শিশির আজিম আকাশ। তিনি বলেন, প্রয়োজনে শিশুর সঙ্গে অভিভাবকদেরও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এতে করে শিশুরা সহিংসধর্মী খেলাধুলার প্রতি কম ঝোঁকার সুযোগ পাবে। অন্যদিকে তাদের সামাজিকীকরণের দিকটিও পরিস্ফূটিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জানান, ছোটবেলায় শিশুরা পিস্তল, তলোয়ার বা ট্যাংক জাতীয় যেসব খেলনা দিয়ে খেলাধুলা করে সেটি অভিভাবদের উচিত তাদের হাতে তুলে না দেয়া। কারণ এসব খেলনার মাধ্যমে ছোট বয়স থেকেই শিশুর মধ্যে সহিংসতা বা হিরোইজমের প্রবণতা তৈরি করবে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এসব খেলনা কোনো কোনো শিশু-কিশোরের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি করে। সে খেলার ছলেই এগুলো দিয়ে অন্যকে আক্রমণ করে বসে। যেটা বড় হওয়ার পরও তার আচরণের মধ্যে থেকে যায়। তবে সবার মধ্যে এটা থাকে না। গুটি কয়েক শিশুর মধ্যে থেকে যায়।
যাদের মধ্যে থেকে যায় তারা পরবর্তী সময়ে অন্যকে আক্রমণ করা বা অন্যের ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এতে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। মূলত একজন কিশোর তার বয়সগত বৈশিষ্ট্যের কারণে একটি সময় তার কাছে যেটি খেলার উপকরণ, সেটি ব্যবহারের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বলে মনে করেন এ অপরাধ বিশেষজ্ঞ।
বিভিন্ন গবেষণার কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রান্তিক অর্থনীতির পরিবারগুলোর শিশু বা কিশোরদের মধ্যে সুস্থভাবে বা সম্প্রতির বোধ নিয়ে বেড়ে ওঠার দিকনির্দেশনা বা সহযোগিতা অনেক সময় দিতে পারে না। এতে এসব শিশুর আচরণের ক্ষেত্রে খেলাধুলার যে উপকরণগুলোর সঙ্গে অপরাধের যোগসাজশ রয়েছে; সেগুলো কারও কারও ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কিশোর অপরাধ কমাতে সন্তানদের যথাযথ কাউন্সেলিং করার পরামর্শ দেন তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, এসব খেলনা একটা নির্দিষ্ট সময় পর বা একেবারেই শিশুদের নাগালের বাইরে রাখার চর্চা করা সম্ভব হলে এটি খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
Advertisement
বর্তমানে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বেপরোয়াভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এসব গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে বেশি। শুরুতে আড্ডা, পার্টি বা নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধে যুক্ত থাকলেও এখন তা বিস্তৃত হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে।
আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে জবরদখল ও মাদকবাণিজ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বখাটে কিশোরদের। অন্যদিকে কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করে ফায়দা নিচ্ছেন স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণকারী এমন অর্ধশত ব্যক্তির নামও রয়েছে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দাদের হাতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম আজাদ সময় সংবাদকে বলেন, মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারে শিশু সংখ্যা অধিক হওয়ায় বাবা-মা তাদের ঠিক মতো খেয়াল রাখতে পারেন না। এতে অনেক সময় শিশু-কিশোররা সঙ্গদোষে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র বা খেলনা জাতীয় সরঞ্জাম হাতে পেলে তারা নিজেদের অনেক বড় মনে করে। ফলে আধিপত্য বিস্তারে কিশোর অপরাধ ঘটায়।
Advertisement
তবে মোহম্মদপুর এলাকায় কিশোর অপরাধ অনেকাংশে কমে এসেছে উল্লেখ করে ওসি বলেন, এ এলাকায় কিশোর অপরাধ পুরোপুরি কমে এসেছে বলা যাবে না। তবে আগের চেয়ে কমেছে। বর্তমানে এটি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এজন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কি ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করছে সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। কারণ পুলিশের পক্ষে ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি করা সম্ভব নয়। তবে পুলিশকে জানালে পুলিশ অবশ্যই পদক্ষেপ নেবে।