ভিডিও বেচাকেনা চক্রের হোতা মার্ক সাকারবার্গ! (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,সোমবার, ২২ মে ২০২৩ : মেয়েদের ব্যক্তিগত এবং আপত্তিকর ভিডিও সংগ্রহ করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করার রমরমা কারবার ফেঁদে ছিলো একটি চক্র। শুধু ভিডিও বেচাকেনাই নয়, মেয়েদের ব্লাকমেইল করে সর্বস্বান্ত করতো চক্রটি। এমনই এক চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

Advertisement

সোমবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, এই চক্রের হোতা আবু সায়েম নিজেকে পরিচয় দিতেন মার্ক সাকারবার্গ বলে।

ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের নামকরণ করেন অভিযুক্ত আবু সায়েম। আর এই সাকারবার্গের ফাঁদে পড়েছেন লাখ লাখ তরুণ-তরুণী। টেলিগ্রামে একটি গ্রুপ থেকে প্রলুব্ধ করে পমপম নামে এক অ্যাপের মাধ্যমে করতেন পর্নো ব্যবসা। এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির ফাঁদে ধরা পড়েছেন সাইবার অপরাধী সায়েমসহ ৯ জন।

গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান জসীম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।

Advertisement

সিআইডি প্রধান বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করে আসছে। একই সঙ্গে অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে তারা। চক্রটি তরুণীদের ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে গোপন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখাতো।

পরে তারা ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ দাবি করতো। অর্থ দিতে না পারলে সেসব তরুণীদের ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করা হতো। আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভিকটিমদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ সেসব গোপন ছবি ও ভিডিও লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিতো।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে পমপম নামে টেলিগ্রাম গ্রুপ তাদের গোপন ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে, অর্থ দাবি করছে। অর্থ দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করছে।

আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভিকটিমদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিচ্ছে।

এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার কোমলমতি তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করে তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল।

গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশ-বিদেশে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে।

প্রতি মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছে। তারা অল্প বয়সী মেয়েদের আপত্তিকর ওইসব ভিডিও ক্রয় ও সংরক্ষণ করে থাকে।

সিআইডি প্রধান আরও বলেন, চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক সাকারবার্গ নামের এক ব্যক্তি। শুরুতে খুবই চতুর এই মার্ককে চিহ্নিত করা সহজ ছিলো না। মার্কের আসল নাম আবু সায়েম। বেকার সায়েম থাকে চট্টগ্রামে।

এনআইডি অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর। সে শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছে। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।

এক ভুক্তভোগী ও তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পমপম গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে ডিএমপির তেজগাঁও থানায় মার্ক সাকারবার্গ ও তার দলের নামে পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হয়। সেই মামলার তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক সাকারবার্গ ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মার্কের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায়।

পরে নিশ্চিত হওয়া যায় যে আবু সায়েমই মার্ক-সাকারবার্গ।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল ও গ্রুপ আছে তার অ্যাডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট জোগাড় করা।

নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো।

মূলত ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকরাই এই চক্রটিকে নতুন নতুন কন্টেন্ট দিত। অর্থাৎ সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তারা ক্যামেরাবন্দি করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে তুলে দিত।

মার্ক তার অ্যাডমিনদের ফেসবুক থেকে ছবি নিয়ে ও মিউজিক বসিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের ভিডিও বানিয়ে গ্রুপগুলোতে আপলোড করত। এ প্রমো দেখে যারা ফুল ভার্সন দেখতে চায়, তাদের এক থেকে দুই হাজার টাকা খরচ করতে হয়।

মার্ক ওরফে সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের অ্যাডমিনদের আসল পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে।

দেখা যায়, তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান।

Advertisement

মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা ও নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া।

মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও।

সিআইডি প্রধান বলেন, সায়েম ও মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই অ্যাডাল্ট গ্রুপগুলোর অ্যাডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদেরকে গ্রেপ্তারে বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় গেট টুগেদার ফাঁদ পাতা হয়।

ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ অ্যাডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

মার্ক-সাকারবার্গ এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও ও প্রায় ৩০ হাজার কন্টেন্ট রয়েছে।

অন্যদিকে মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে সাতশ মানুষ।

তিনি আরও বলেন, আমরা তাদের বিস্তারিত পেয়েছি। তাদের নিয়েও কাজ করছি। তরুণীদের এডাল্ট কন্টেন্ট কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান মোহাম্মদ আলী মিয়া। বলেন, একে একে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে জানিয়ে মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এই কাজটি ছিল ভীষণ স্পর্শকাতর একটি কাজ। ফলে তদন্ত চলার সময় ভুক্তভোগী কিশোরী মেয়েদের কান্না, তাদের আপত্তিকর ভিডিও গ্রুপগুলো থেকে সরিয়ে নিতে এডমিনদের প্রতি করুণ আকুতি, আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। জেনেছি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। বোনের ভিডিও সরিয়ে নিতে ভাইয়ের কান্নাও চোখে পড়েছে।

সিআইডি প্রধান বলেন, এ ঘটনায় মানিলন্ডারিং তদন্ত করারও পরিকল্পনা করেছি। তাহলে কেবল টেলিগ্রাম চক্রের হোতারাই নয়, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা এই চক্রের সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে।

অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, সন্তানের ভুলে তাকে একা করে না দিয়ে পাশে থাকুন, আইনের আশ্রয় নিন। অপরাধী যত শক্তিশালী হোক না কেন আমরা তাকে আইনের আওতায় আনবো।