ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শুক্রবার, ১৯ মে ২০২৩ : বিয়ের তিন দিন পরই নির্মমতার শিকার হন মনিরা পারভীন। শশুড়বাড়ির লোকজনের নির্যাতনে মেহেদীর রং মুছার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। আদরের মেয়েকে হারিয়ে মনিরার মা এখনো কাঁদছেন। বাবাও কম পাচ্ছেন না কষ্ট।
Advertisement
প্রায় ১০ বছর আগে রাজধানীর খিলক্ষেত থানা এলাকায় নববধূ মনিরা পারভীনকে যৌতুকের জন্য হত্যা করে শশুড়বাড়ির লোকজনেরা। এ ঘটনায় মনিরার বাবা খিলক্ষেত থানায় মামলা করেন। দীর্ঘদিন পর বৃহস্পতিবার মামলার রায় এসেছে। রায়ে মনিরার দেবর-ননদসহ ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। মনিরার স্বামী নাসির হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
Advertisement
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক মাফরোজা পারভীনের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। বিচারক বলেন, এটা ফুল ব্লাডেড মার্ডার। মৃত্যুদণ্ড দিতে বাধ্য হয়েছি।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন-নাসিরের ভাই মাসুদ, বোন হাসিনা ও তার স্বামী মিলন, মিলনের ভাই দেলোয়ার হোসেন ও নাসিরের চাচা দিন ইসলাম। এরা সবাই জামিনে থেকে আদালতে হাজিরা দেন। রায় শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
Advertisement
মনিরার বাবা মোস্তফা বলেন, ২০১৩ সালের ১৮ জুন মঙ্গলবার বিকেলে মনিরাকে তুলে নিয়ে যায়। আর খুঁজে পাই না। চিন্তায় ছিলাম। রাত ১১টা কি ১২ টা বাজে, তখন ঘরের কোনায় এসে একজন বলে যাই, চিন্তা কইরেন না মনিরার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরও মনিরাকে খুঁজতে থাকি। বৃহস্পতিবার মনিরা ওর বোন আদিবাকে ফোন করে। বলে নাসিরের বাড়ির লোকজন বাড়ি যেতে পারে। ফলমূল কিনে রাখতে। আমরা সবকিছু কিনে রাখি। কিন্তু আসে না। ওরা তখন বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে নাসিরের এক বান্ধবীর বাসায় ছিল। আমরা জানতাম না। আমরা মনিরাকে খুঁজতে থাকি। পরে নাসিরের বাড়ি যাই। নাসিরের বাড়ির লোকজন বলে, বাড়ি গেলে মনিরাকে খুন করবে। নাসিরের মা ১০ লাখ টাকা যৌতুক চায়।
তিনি বলেন, শুক্রবার নাসিরের মা-বাবা বিয়ে মেনে নেয়। পরে নাসির মনিরাকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাই। নাসিরের পরিবারের লোকজন ১০ লাখ টাকা যৌতুকের জন্য মনিরাকে মারধর করে। নাসিরকে বেঁধে রাখে। এর মাঝে মনিরা ওর বোনকে ফোন দিয়ে জানায়, ওকে মারধর করছে। মনিরাকে আধমরা করে পাশে বালুর মাঠে ফেলে রাখে। ওরা আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিল। পরে লোকজন মেয়েটাকে আশিয়ান সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। হাসপাতালটি ছিল নাসিরেরর চাচীর আত্মীয়ের। সেখানে মনিরাকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। মনিরার চাচা পুলিশকে জানালে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার বলে অপারেশন করতে হবে। রক্ত জোগাড় করুন। আমি ভাবছি, হয়তো হালকা মেরেছে। এ কারণে এতো গুরুত্ব দেয়নি। সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালে যায়। তখন আমার মেজ মেয়ে হাবিবা বলে, আব্বা, আপা আর নাই।
মোস্তফা বলেন, জুনের ২২ তারিখ হবে মেয়ে মারা যাওয়ার ১০ বছর। মেয়েকে হত্যার পর ওর মা মানসিক রোগী হয়ে গেছে। মেয়েটাকে মারেনি, আমার পুরো সংসারটা মেরে ফেলেছে। রায় পেয়েছি। রায়ে সন্তুষ্ট। প্রত্যাশা, উচ্চ আদালতে যেন এ সাজা বহাল থাকে। কষ্ট স্বার্থক। ১০ বছরের ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।
Advertisement
মনিরার বোন হাবিবা আক্তার ইভা বলেন, বোনটা আমার সংসার করতে পারেনি। তার আগেই নিষ্ঠুরভাবে খুন করে ওরে। আমার মায়ের খুব শখ ওদের হাতকড়া অবস্থায় ছবি দেখার। আজ মায়ের আশা পূরণ হলো।
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রেজাউল করিম জানান, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সচেষ্ট হয়। সবকিছু বিচার, বিশ্লেষণ করে আদালত রায় দিয়েছেন। ৫ জনকে সাজা দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। ভুক্তভোগী পরিবারটি ন্যায়বিচার পেয়েছে।
মনিরার স্বামী নাসির হোসেনের আইনজীবী ইলতুৎমিশ সওদাগর জানান, নাসিরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাই। সে মনিরাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তার কোনো ইলভল্পমেন্ট নাই। সে একজন ইনোসেন্ট মানুষ। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি নাসির খালাস পেয়েছেন।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৮ জুন বিকেল সাড়ে ৫টার মনিরা ওষুধ কেনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসে না। পরিবার তার কোনো সন্ধান পাচ্ছিল না। পরদিন লোকমুখে জানতে পারেন নাসির হোসেন কাজী অফিসে নিয়ে তাকে বিয়ে করেছে। এ কথা শোনার পর মনিরার বাবা মোস্তফা নাসিরের বাবা হাছেন আলীর কাছে যান এবং মেয়েকে উদ্ধার করে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করেন। তখন হাছেন আলী ক্ষিপ্ত হয়ে তার কাছে ১০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। যৌতুকের টাকা না দিলে বাবা, মেয়েকে খুনের হুমকি দেন তিনি। পরদিন নাসির মনিরাকে নিয়ে তার বাড়িতে আসেন। বাড়িতে আসার সাথে সাথে নাসিরের বাবা, মাসহ পরিবারের অন্যরা মিলে মনিরাকে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে মারপিট, কিল, ঘুষি, মাথার চুল টেনে গুরুতর জখম করে পাশের একটি বালুর মাঠে ফেলে রাখেন। স্থানীয় লোকজন মনিরাকে উদ্ধার করে আশিয়ান সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবার। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুন সকালে মারা যান মনিরা।
এ ঘটনায় ২২ জুন মনিরার বাবা মোস্তফা খিলক্ষেত থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় নাসিরের বাবা, মা, চাচাসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। তবে মামলাটি তদন্ত করে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা খিলক্ষেত থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কেএম আশরাফ উদ্দিন। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলার বিচার চলাকালে আদালত ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।