ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),শরিয়তপুরের জাজিরা প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ০৯ মে ২০২৩ : ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একটি দালাল চক্রের বিরুদ্ধে। মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে ২০ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এদেরই একজন হুমায়ুন ঢালী। তিনি আগে ছিলেন ছাগলের দালাল। এই কয়েক বছরে তিনি হয়েছে কোটিপতি। সরেজমিন অনুসন্ধান করে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
Advertisement
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের হাওলাদারকান্দি গ্রামের আবদুল হক ঢালীর ছেলে হুমায়ুন ঢালী। ৫ বছর আগেও জাজিরার কাজির হাটসহ কয়েকটি হাটে ছাগল বিক্রির দালালির পাশাপাশি জমিতে ট্রাক্টর চালিয়ে হাল চাষ করতেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হুমায়ুনের একসময় নিজের ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনও জমি ছিল না। গত ৫ বছরে তিনি হয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। মাত্র কয়েক বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া হুমায়ুন এখন মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
Advertisement
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর-নাওডোবা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় তিনটি প্যাকেজে ২৭ কিলোমিটার সড়ক চার লেন, ২৭টি কালভার্ট ও ২টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ২৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে জমি অধিগ্রহণে। আর এই ক্ষতিপূরণের টাকা দিচ্ছে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। শরীয়তপুর থেকে নাওডোবা পর্যন্ত সড়ক চার লেন করার প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই দুই পাশে স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে।
নাওডোবা-জাজিরা আঞ্চলিক সড়কের বিকেনগর ইউনিয়নের দৈনিক বাজার এলাকায় হুমায়ুন ঢালীর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পাঁচতলা বিশিষ্ট অট্টালিকা নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে দুই তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়াও জানা গেছে, অতিরিক্ত বিল উত্তোলন করার উদ্দেশে তার বাড়িতে টিনের ৫টি চৌচালা ঘর উত্তোলন করা হয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে
২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকেনগর এলাকার চানমিয়া শেখের কাছ থেকে ২২ শতাংশ জমি কেনেন হুমায়ুন ঢালী। যার দলিল নং ৮০১/২০। ওই বছরের গত ৯ জুন একই এলাকার জলিল শিকদারের কাছ থেকে ১৬.৫ শতাংশ কেনেন। যার দলিল নম্বর ১২৮৭/২০। একই বছরের গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এলাকার দানেছ শেখের কাছ থেকে ২১ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার দলিল নং ৬৬৩/২০। ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট একই এলাকার আবদুল জলিল শিকদারের কাছ থেকে ১৬.৫ শতাংশ কেনেন ঢালী। যার দলিল নং ৩১২৩/১৯।
হুমায়ূন ঢালীর নিজ নামে ক্রয় করা জমিবিক্রেতা জাকির শিকদার বলেন, আমি গত দেড় দুই বছর আগে দুইটা জমি হুমায়ূন ঢালীর কাছে বিক্রি করেছি। জমির পরিমাণ একটি ৪ কাঠা, অন্যটি ৫ কাঠা। একটি ২৩ লাখ, অন্যটি ৫ লাখ টাকা। হঠাৎ শুনি, হুমায়ূন ঢালী অনেক জমি কিনতেছেন। তখন তার কাছে জমি বিক্রি করেছি। শুনেছি, ব্রিজের ওখান থেকে (পদ্মা সেতু) টাকা কামাই করছে। মানুষের বিল নাকি কী করে নিয়ে গেছে। কেমনে কী করছে তা জানি না।
Advertisement
আরেক জমিবিক্রেতা ইদ্রিস হাওলাদার বলেন, আমি ৭ শতাংশ ও আমার চাচা ২০ শতাংশ জমি হুমায়ূন ঢালীর নিকট বিক্রি করেছেন। ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা করে শতাংশ দাম দিয়েছে। হুমায়ুন ঢালী আগে সংসারী কাজ করতেন। কোথায় এত টাকা পেলো তা জানি না। সে ৫/৬ বিঘা জমি কিনেছে জানি।’
এ ব্যাপারে জাজিরা উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী ইস্কান্দার আলী ভূঁইয়া বলেন, আমি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। গত এক বছর আগে দেশে এসে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হয়েছি। হুমায়ুন ঢালীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। পাঁচ বছর আগেও নিম্ন ফ্যামিলির ছিল তারা। এখন অর্থবিত্ত হয়েছে। তবে কীভাবে এত টাকা-পয়সা হইলো, কী ব্যবসা করে- তা আমার জানা নেই। আমি জানি, ৫/৭ বছর আগে এমনিই কৃষি কাজ করতো। বর্তমানে আমাদের সাথে রাজনীতিতে জড়িত সে। তাকে কোনও পদ দেওয়া নাই। নির্দিষ্ট কোনও ব্যবসা নাই তার। এখন আবার দুবাই যাওয়া-আসা করে।
স্থানীয় খোকন হাওলাদার বলেন, হুমায়ুন ঢালী আমার পরিচিত। আমাদের পাশেই বাড়ি। ছোট থেকে একত্রে বড় হয়েছি। ওরে ৪ বছর আগেও মেশিন (পাওয়ার টিলার) চালাইতে, কৃষি কাজ করতে দেখেছি। কাজীর হাটে বকরী-ছাগলের দালালি করতো। হঠাৎ করেই দেখি ও অনেক জমিজমা কিনেছে। অনেক বড় বিল্ডিং করছে। কদিন আগে টিভিতে দেখেছি, মাদারীপুরের ডিসি তার নামে দুদকে একটা মামলা দিয়েছে।
হুমায়ূন ঢালীর মা জমিলা খাতুন বলেন, হুমায়ুন আগে মেশিন (পাওয়ার টিলার) চালাইছে, ধান ভাঙাইছে। আমার বাবার-কালের জায়গাজমির টাকা-পয়সা পাইছি ২০ লাখ। অন্য ছেলেদেরসহ হুমায়ূনকে সেই টাকার ভাগ দিয়েছি।
হুমায়ুন ঢালীর মেয়ে ফাতেমা আক্তারের (১৯) কাছে বাবার এত অর্থ-সম্পদের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাবা দুবাইয়ে অন্য রকমের ব্যবসা (সাবান, শ্যাম্পু, কসমেটিক্স) ব্যবসা করেন।
এ ব্যাপারে হুমায়ূন ঢালীর বক্তব্য নিতে তার বাড়িতে গেলে তিনি পরিচয় গোপন করে কৌশলে সটকে পড়েন। পরে তাকে ফোন করা হলে তিনি বিভিন্ন ব্যস্ততা দেখিয়ে বলেন, ‘আমি বিদেশে ছিলাম, বর্তমানে দুবাই থেকে কসমেটিক্সের ব্যবসা করি। ব্যবসার লাইসেন্স নেই, তবে এয়ারপোর্টে ট্যাক্স দিই। আমার নানার-কালে ৫০ বিঘা জমির বিল পেয়েছি। বাবার-কালের দেড় কোটি টাকার জমি বিক্রি করেছি আমরা চার ভাই। আমি কোনও জমি কিনি নাই।
সদ্য নির্মিত তার এত বড় অট্টালিকা বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাড়ি বাবা করে রেখে গেছেন। বাবা মারা গেছেন ৭ বছর আগে। বাবা এক জন কৃষক ছিলেন। এগুলো সব মিথ্যা কথা।
এ বিষয়ে শরিয়তপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, আমাদের এখান থেকে কোনও ধরনের অনৈতিক কাজ করার সুযোগ নেই। দালালদের তালিকা পেলে প্রয়োজনে আমাদের অফিসে টাঙিয়ে রাখা হবে। কেউ যাতে অনৈতিক সুবিধার না নিতে পারে তার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এ বিষয়ে মাদারীপুর পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি নয়, আমরা সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা তদন্তপূর্বক সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেব।