একাত্তরের হাতে ফোনালাপের রেকর্ড ও ট্রলারের ভিডিও ডাকাতি করতে পাঠানো হয়েছিল ট্রলারের ১০ জনকে

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),কক্সবাজার প্রতিনিধি,শুক্রবার, ০৫ মে ২০২৩ : কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপকূলে একটি ট্রলারে ভেসে আসা ১০ মরদেহ উদ্ধারের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ডাকাতি করতে গিয়েই মাঝি ও জেলেদের পিটুনিতে তাদের মৃত্যু হয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

Advertisement

মরদেহ নিয়ে সাগরে ভাসা ট্রলারটির একটি ভিডিও ফুটেজ এবং এ সংক্রান্ত ফোনালাপের রেকর্ড একাত্তরের হাতে এসে পৌঁছানোর পর হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ফোন রেকর্ডিংয়ের কথোপকথন থেকে জানা গেছে, সাগরে মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি করতেই সুমন নামের আত্মস্বীকৃত একজন ডাকাত ওই ১০ জনকে সাগরে পাঠিয়েছিলো। সেখানেই একটি ট্রলারে ডাকাতি করতে গেলে আরও চারটি ট্রলার তাদের ঘিরে ফেলার পর পিটিয়ে হত্যা করে।

হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় চার ট্রলারের অন্তত ৫০ জন মাঝি ও জেলে। বরফ ভাঙার মুগুর, বাঁশ ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাদেরকে হত্যা করার পর ট্রলারটি ভাসিয়ে দেয়া হয় সাগরে।

Advertisement

নিহতদের কয়েকজনের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাগরে মাছ শিকারে যাওয়ার কথা বলে এপ্রিলের শুরুতে অনেকটা গোপনে মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও চকরিয়ার বেকার যুবকদের জড়ো করে একটি চক্র।

গত আট এপ্রিল ১৪ যুবককে নিয়ে মহেশখালীর হোয়ানক কালা গাজীর ঘাট পাড়া থেকে সাগরে রওনা দেয় শামসু মাঝির একটি ট্রলার। তবে কয়েকদিন পার হয়ে গেলেও সাগরে যাওয়া এই জেলেদের কোনও খোঁজ পাচ্ছিল না তাদের পরিবার।

ব্যাপারটি সন্দেহজনক হওয়ায় পুলিশের সহযোগিতা পেতে থানায় যান নিখোঁজদের স্বজনরা। তবে পুলিশ তাদের কোনও কথা শোনেনি।

তাদের অভিযোগ, পুলিশ এমনকি সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত করতে রাজি হয়নি। শুধু পুলিশ নয়, তখন কোনও জনপ্রতিনিধির সহায়তাও পাননি তারা।

নিখোঁজদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে একাত্তরের কথা হয় বাবু সানি নামে এক জেলের সাথে। সেদিন তার সামনেই ডাকাত ধরার কথা বলে সাগরে রওনা দেয় আনোয়ার, ফারুখ আর মাঝিসহ চারটি ট্রলার।

পরে তারা কুলে ফিরে এসে শামসু মাঝির ট্রলারে থাকা লোকজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পর কোল্ড স্টোরে ঢুকিয়ে রাখার সরল স্বীকারোক্তি দেয় বাবু সানিকে।

এদিকে, নিখোঁজের ১৫ দিন পর গত ২৩ এপ্রিল কক্সবাজারের নাজিরারটেকে ভেসে আসে একটি ট্রলার। সেই ট্রলারের কোল্ড স্টোর থেকে উদ্ধার করা হয় দশটি মরদেহ।

মৃতদেহগুলো মর্গে আনা হলে ওসমান গণি, সওকত উল্লাহ, নুরুল কবির, শামসু মাঝি, শাজাহান ও তারেকের মরদেহ সনাক্ত করেন স্বজনরা। তারা সোনাদিয়ার সুমন ডাকাতের কথায় সাগরে গিয়েছিলো বলে দাবি স্বজনদের।

সেদিন ১৪ জন সাগরে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। আর মরদেহ মিলেছে ১০ জনের। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, বাকি চারজন তাহলে কোথায়।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে জেলেদের সংখ্যায় গড়মিল হতে পারে। এটি নিয়েও তদন্ত চলছে বলে জানান তারা।

ঘটনার পর একটি ফোনকলের রেকর্ড আসে একাত্তরের হাতে। ফোনে কথা বলছিলেন সোনাদিয়ার আত্মস্বীকৃত ডাকাত সুমন ও মনির। তাদের কথোপকথনেও স্পষ্ট হয় শামসু মাঝির ট্রলারে মহেশখালী থেকে ১৪ জেলের সাগরে যাওয়ার রহস্য।

আত্মস্বীকৃত ডাকাত সুমন

ফোনে সুমনকে বলতে শোনা যায়, তাদের সাগরে মরতে পাঠাইনি। টাকা কামাতে তারা স্বেচ্ছায় সাগরে গিয়েছিল।

এ থেকেই স্পষ্ট হয়, মাছ ধরা নয় বরং ডাকাতি করতেই তাদেরকে সাগরে পাঠানো হয়েছিলো।

কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন দুইজন।

পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানা যায় কীভাবে ঘটেছে এই হত্যাকাণ্ড।

পুলিশের হাতে আটক বাইট্টা কামালসহ দুজন জানান, সাগরের মাঝখানে বাইট্টা কামালের মালিকানাধীন আনোয়ার মাঝির ট্রলারে হামলা করে শামসু মাঝির ট্রলার। যাতে ছিলেন সেই ১৪ জন জেলে।

তখন তাদের ঘিরে ঘিরে ফেলে বাবুল মাঝি, আমানুল্লাহ ও আবছার মাঝিসহ চারটি ফিশিং ট্রলার। ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতদের গণপিটুনি দিয়ে সেখানেই হত্যা করা হয়। এরপর ট্রলারটি ভাসিয়ে দেয়া সাগরে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও জানান, আত্মস্বীকৃত ডাকাত সুমন ২০১৮ সালে কক্সবাজারে জলদস্যু হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তবে সে কীভাবে আবারও পুরনো পেশায় ফিরে এলো তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

হত্যার পর ট্রলারটি ভাসিয়ে দেয়ার একটি ভিডিও এসেছে একাত্তরের হাতে। ভিডিওতে ভাসমান ট্রলারটির মাথায় লাল ও নীল রং আছে। চারটি ট্রলার দাঁড়িয়ে থাকলেও, ভাসমান ট্রলারটিকে উদ্ধার করতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।

নাজিরারটেকে ভেসে আসা মরদেহভর্তি ট্রলারের সাথে ভিডিওর ট্রলারটির মিল পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, অন্য কোন ট্রলারের জেলেরা এই দৃশ্য ধারণ করেছিল।

কক্সবাজার পরিদর্শনে এসে পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এমন কেউ আবারও জলদস্যুতায় জড়িয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।