ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),যশোর প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৩ : ২৯০ টাকা কেজি গরুর মাংস, ৮০ টাকা কেজি পোলাও চাল, ১২০ টাকা লিটার সয়াবিন তেল আর ৪৫ টাকায় চিনি! আর এই পণ্য কিনলে উপহারে মিলছে সেমাই, কিসমিস, বাদাম, গুড়ো দুধ, মাংসের মসলা! এমনই বাজার খুলেছে যশোরের আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা। ‘মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার’ নাম দিয়ে এভাবেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের পাশে দাঁড়িয়েছে আইডিয়া সমাজ কল্যাণ সংস্থা। এখানে বাজারের মোট ১২৭০ টাকার পণ্য এক জন ক্রেতা কিনেছেন মাত্র ৫৩৫ টাকায়।
Advertisement
রমজানের এক মাস সফলভাবে ‘লস প্রজেক্ট’ শেষ করার পর ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে এবার স্থাপন করা হলো এ ‘ঈদবাজার’। মঙ্গলবার যশোর শহরের খড়কি এলাকায় আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা চত্বরে বসেছিল ব্যতিক্রমী এই ‘মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার’। এর আগে এ প্রজেক্টের আওতায় পবিত্র রমজান মাসে সংগঠনটি কম দামে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করে। ৪৩৫টি পরিবার সপ্তাহে এক দিন করে মোট চার সপ্তাহ এখান থেকে পণ্য কেনার সুযোগ পেয়েছে।
Advertisement
আইডিয়া থেকে ঈদবাজার করতে আসা খড়কি রেললাইন এলাকার বৃদ্ধা সামেত্তাবানু বলেন, গত বছর মেয়েবাড়ি গেছিলাম, তখন গরুর মাংস খাইলাম। এর মধ্যে মাঝেমধ্যে পোল্ট্রি খেলেও গরু খায়নি কখনো। গরু যে খাবো! কেনার সামর্থ্য নেই। স্বামী বছর খানিক হলো স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে রয়েছে। আজ আইডিয়া থেকে সাড়ে ৭০০ টাকার মাংস ২৯০ টাকায় কিনবো। এই গরুর গোস্ত ঈদের দিন রান্না করে অসুস্থ স্বামী আর ছেলেপেলেদের খাওয়াবো।
আমেনা বেগম নামে আরেক বৃদ্ধা জানান, ‘স্বামী নেই। ছেলেরা ঠিকমত দেখে না। কবে গরুর গোস্ত খাইছি মনে নেই। তাও সেটা আত্মীয়-বাড়িতে। ঈদের দিন গরুর গোস্ত খাতি পারবো। অল্প টাকায় দেচ্চে বইলে কিনতি পারিচি।’
Advertisement
খড়কি কবরস্থান এলাকার ভাড়াটিয়া রিকশাচালক আনোয়ারের স্ত্রী নাসিমা বেগম বললেন, ‘রমজান মাসে কম দামে চাল, তেল, চিড়ে, ছোলা কিনিছি। এখন অর্ধেকের কম দামে গরুর গোস্ত, পোলাও চাল পাচ্ছি। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, এরা যেন আর বেশি বেশি মানষির জন্যি করতি পারে।’
নাছিমা খাতুন নামে এক ক্রেতা জানান, ‘ঈদের দিন হয়তো ব্রয়লার কিনতাম ছেলেমেয়ের জন্য। পোলাও কিংবা গরুর মাংসের কথা ভাবনায়ও আসতো না। সেখানে এই সংস্থার জন্যে আমরা সাধ্যের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা পেয়েছি। এবার ঈদে আমার ছেলেমেয়েও পোলাও-মাংসের স্বাদ নিতে পারবে।’
Advertisement
আয়োজকরা জানান, যশোরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থার ‘আইডিয়া-সানাবিল লস প্রজেক্টে’র অধীনে ‘মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার’ এ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ৫৫৭টি পরিবার বাজার করতে পেরেছে। রমজান মাসব্যাপী প্রতিষ্ঠানটি ‘আইডিয়া-সানাবিল লস প্রোজেক্ট’র আওতায় ৫৫৭টি মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ৯টি পণ্য বাজারদরের অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করেছে; ৪র্থ সপ্তাহে এসে ‘মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার’ এর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হচ্ছে এই প্রকল্প।
‘মানবকল্যাণে আমরা ঠকতে চাই’- এই শ্লোগানকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের বসানো এই ভিন্নধর্মী এই বাজার দেখতে মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে যান যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান, স্থানীয় সরকার বিভাগ যশোরের উপ-পরিচালক রফিকুল হাসানসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ।
Advertisement
পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান শিক্ষার্থীদের এই মহতী উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, মাসব্যাপী আইডিয়ার এই ভিন্নধর্মী বাজার রীতিমত সাড়া ফেলেছে সারাদেশে। যশোরের একঝাঁক স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী এভাবে যোগ হয়ে এই ভালো কাজ করছে। রমজানে মাসে অন্যদেশে পণ্যের দাম কমলেও আমাদের দেশে বাড়ে। এনাদের এই উদ্যোগ সেইসব ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকরণীয়।
আইডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান উপদেষ্টা সহকারী অধ্যাপক মো. হামিদুল হক শাহীন বলেন, মধ্যবিত্তের ঈদবাজার কোনো দান নয়, ত্রাণ নয়- বরং মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
একঝাঁক শিক্ষার্থী যোগ হয়ে মাসব্যাপী মানবকল্যাণে ঠকতে চাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলো রমজান মাসব্যাপী। সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন নানান বিত্তবান ও চিত্তবান মহৎ মানুষেরা। সাধ্য থাকলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর লাভের-লোভের নির্মম শিকার হয়ে বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ্যের বাইরে ঈদবাজারের পণ্যসামগ্রী। আমরা যোগ হয়ে চেষ্টা করেছি কিছু সংখ্যক মধ্যবিত্ত পরিবারের ঈদ আনন্দের শামিল হওয়ার এবং সারাদেশের জন্য একটি মডেল উপস্থাপনের- এভাবে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়।
সব মিলিয়ে মাসজুড়ে এই প্রজেক্টে প্রায় ১২ লক্ষাধিক টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সংগঠনটি।
আইডিয়া লস প্রজেক্টের সমন্বয়ক হারুণ অর রশিদ বলেন, আইডিয়া শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত সমাজকল্যাণমূলক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এই প্রজেক্টের আওতায় শিক্ষার্থীরা মাসজুড়ে ‘লস’ করার উদ্দেশ্যেই নিত্যপণ্যের ব্যবসা করেছেন। অর্থাৎ তারা বেশি দামে জিনিস কিনে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে কম দামে বিক্রি করেছেন।
আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, বর্তমান বাজারে সমাজের উচ্চবিত্তদের সাধ্যের মধ্যে সব পণ্য পাওয়া গেলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ রয়েছেন বিপদে। তারা না পারছেন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে, না পারছেন মানুষের কাছে হাত পাততে। চক্ষুলজ্জায় তাদের কান্নাও লুকিয়ে রাখতে হয়। এ কারণে এমন ৫৫৭টি পরিবারের মধ্যে বাজারের অর্ধেক দামেও কম দামে গরুর মাংস, পোলাওয়ের চাল ও চিনি বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া উপহার হিসেবে ক্রেতাদের দেওয়া হয়েছে সেমাই ও মসলাসহ পাঁচটা পণ্য।