ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),খুলনা প্রতিনিধি,বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ : খুলনার আলোচিত সেই ওসি শেখ আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রীর নামে থাকা সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার ৫ কাঠা জমিসহ বিলাসবহুল ৫ তলা বাড়ি ক্রোক করেছে দুদক। বাড়ির সামনে মঙ্গলবার ক্রোকের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে সংস্থাটি।
Advertisement
অবৈধভাবে অর্জিত তার অন্যান্য জমিতেও একইভাবে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাবেক ওসি আবু বকর সিদ্দিক। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তা ভোগ করতে পারছেন না তিনি।
নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকা প্রথম ফেজের ১০ নং রোডে ১৪২ নং প্লটে আবু বকরের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, খুলনার ক্রোক বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে।
সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘ক্রোকাবদ্ধ উক্ত সম্পত্তি এবং সম্পত্তির উপর নির্মিত ৫ তলা ভবন কোনোভাবে বা প্রকারে অন্যত্র হস্তান্তর, উক্ত সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট কোনো প্রকার লেনদেন বা উক্ত সম্পত্তি এবং সম্পত্তির উপর নির্মিত ভবন কোনোভাবে দায়বদ্ধ করা আইনত নিষিদ্ধ।’
দুদক খুলনার উপ-পরিচালক এম এ ওয়াদুদ জানান, জমি ও বাড়িটি সাবেক ওসি আবু বকরের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া পারুলের নামে রয়েছে। তারা ৫ তলা বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় থাকেন। অন্য ৪টি তলা একটি আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার কাছে ভাড়া দেওয়া রয়েছে। বাকি ৪টি তলা দ্রুততম সময়ের মধ্যে খালি করে দিতে বলা হয়েছে। এগুলো খালি করার পর ‘রিসিভার নিয়োগের’ জন্য আদালতে আবেদন করা হবে। এরপর তা ভাড়া দিয়ে যে আয় হবে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শেখ আবু বকর সিদ্দিক চাকরি করেছেন খুলনার বটিয়াঘাটা থানা, খুলনা পিবিআই, চুয়াডাঙ্গা ডিএসবিসহ কমপক্ষে ১২টি স্থানে। অবসরে যাওয়া এই ওসির গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট সদর থানার চুলকাঠি গ্রামে। তবে সোনাডাঙ্গার বাসায় বসবাস করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর তৎকালীন ওসি শেখ আবু বকর সিদ্দিক ও তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া পারুলের বিরুদ্ধে দুদকের খুলনার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে পৃথক দুটি মামলা হয়। দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আল আমীন বাদি হয়ে এ দুটি মামলা দায়ের করেন। তখন আবু বকর সিদ্দিক চুয়াডাঙ্গা জেলা ডিএসবির পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
Advertisement
মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৮৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শেখ আবু বকর সিদ্দিক দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ১৫৬ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন। এছাড়া তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ৩৩ লাখ ৮৫৯ টাকার সম্পদ অর্জন করে নিজ মালিকানা ও ভোগ দখলে রাখেন। সরকারি চাকরিতে থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা স্ত্রীর নামে দান দেখিয়ে বৈধ করার চেষ্টা করেন। এই অপরাধে দুদক ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইনের দুটি ধারায় এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর দুটি ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে অপর মামলায় প্রধান আসামি করা হয় তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া পারুলকে এবং ২নং আসামি করা হয় শেখ আবু বকর সিদ্দিককে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পারুল দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১৬ লাখ ৬৫ হাজার ৯০২ টাকার তথ্য গোপনসহ ১ কোটি ১ লাখ ২৯ হাজার ৯৫৯ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেন। স্বামী আবু বকরের সরকারি চাকরিতে থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা দান হিসেবে গ্রহণ করেন। ঠিকাদারি ব্যবসার মাধ্যমে আয় দেখিয়ে বৈধ করার চেষ্টা এবং আবু বকরের দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকা স্বামীর নামে দান হিসেবে দেখিয়ে বৈধকরণে সহায়তা ও স্বামীকে অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহায়তা করার অপরাধ উল্লেখ করা হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলা হওয়ার কিছুদিন পর আবু বকর ও তার স্ত্রী উচ্চ আদালত থেকে ৮ সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন। জামিনের মেয়াদ শেষ হলে গতবছর ৫ মে তারা ২ জন খুলনা মহানগর বিশেষ দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত জামিনের আবেদন না-মঞ্জুর করে তাদেরকে কারাগারে পাঠান। প্রায় ৬ মাস পর তারা জামিনে মুক্তি পান।
দুদক খুলনার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মুজিবর রহমান জানান, মামলায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ২ কোটি টাকার দুর্নীতি ধরা পড়লেও দুদকের তদন্তে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ সাবেক ওসি আবু বকরের আরও অবৈধ সম্পদ ও সম্পত্তি পাওয়া গেছে। আবু বকর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার জমির মূল্য মাত্র ১৩ লাখ টাকা এবং বাড়ির মূল্য ৮২ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। বাড়িটি বিদেশি টাইলসসহ আধুনিক সব নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি। ওই জমি ও বাড়ির প্রকৃত মূল্য অনেক গুন বেশি।
Advertisement
খুলনা সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় প্রতি কাঠা জমির সর্বনিম্ন সরকারি মূল্য ১১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। সেই হিসেবে ৫ কাঠা জমির মূল্য ৫৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। তবে বাস্তব চিত্র হচ্ছে এখন সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় প্রতি কাঠা জমি ৭০ লাখ টাকা বেচাকেনা হয়।
দুদকের আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান জানান, নগরীর দৌলতপুর থানার পাবলা মৌজায় আবু বকরের সাড়ে ৪ কাঠার প্লট (আবাসিক প্লট নং এন-২৬) রয়েছে। বাগেরহাট সদর উপজেলার যুগিডাঙ্গা মৌজায় ৩৯ শতক জমি, একই মৌজায় আরেকটি স্থানে ৩ দশমিক ৮৫ একর জমি রয়েছে। যা তিনি তার সম্পদ বিবরণীতে দেখাননি। যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। তিনি জানান, আবু বকর তার ছেলেকে ৫২ লাখ টাকা মূল্যের একটি গাড়ি কিনে দেন। যার নং ঢাকা মেট্রো গ-৩৯-৫৪২৫। কিন্তু তার সম্পদ বিবরণীতে তা উল্লেখ নেই। এসব জমির দলিল ও গাড়ির কাগজপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
দুদকের আইনজীবী আরও জানান, গতবছর ২৬ মে আবু বকর ও তার স্ত্রী পারুলের সম্পত্তি আইনত বাজেয়াপ্তকরণ (অ্যাটাচমেন্ট) ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। মহানগর বিশেষ দায়রা জজ আদালতে মামলা চলাকালীন অপ্রদর্শিত এসব সম্পদ-সম্পত্তি আসামিরা যেন হস্তান্তর করতে না পারেন সে জন্য এই আবেদন জানানো হয়। ৩০ মে আদালত স্বামী-স্ত্রীর ৪টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত রাখার নির্দেশনা এবং সম্পত্তির হস্তান্তর বন্ধ রাখতে আইনত বাজেয়াপ্তকরণ (অ্যাটাচমেন্ট) নোটিশ দেয়।
মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদক খুলনার উপ-পরিচালক এম এ ওয়াদুদ জানান, আবু বকরের অন্যান্য জমিও ক্রোক করা হয়েছে, তবে সেগুলো খালি জমি। ওই জমিতেও সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের অপর একজন কর্মকর্তা জানান, আবু বকরের সাতক্ষীরায় জমি আছে কিনা এবং ঢাকায় জমি বা ফ্লাট আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। নগরীর একটি অভিজাত আবাসিক হোটেলে তার শেয়ার থাকার গুঞ্জন রয়েছে, সে বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও এর বাইরে আর কোনো সম্পদ-সম্পত্তি আছে কিনা তাও খুঁজে দেখা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি খুলনার সাধারণ সম্পাদক শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, এতো সম্পদ একজন ওসির পক্ষে চাকরি করে বৈধভাবে অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ভালোভাবে তদন্ত করে অভিযোগপত্র প্রদান এবং শাস্তি দেওয়া উচিৎ। তাহলে অন্য যারা এ ধরণের কাজে সম্পৃক্ত তারা নিরুৎসাহিত হবে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, যার আইন রক্ষা করার দায়িত্ব তিনি যদি ইউনিফর্ম পরে আইন ভঙ্গ করেন তাহলে তার কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার।